অভিব্যক্তির স্বপক্ষে অঙ্গসংস্থানগত ও জীবাশ্মঘটিত বা প্রত্নজীববিদ্যা সংক্রান্ত প্রমাণ (Morphological and Palaentological Evidence in favour of Evolution)
'জীব জগতে অভিব্যক্তি ঘটছে' —এই তথ্যের স্বপক্ষে নানা প্রমাণ পাওয়া যায় । এইসব প্রমাণগুলি হল :
[ক] অঙ্গসংস্থান সংক্রান্ত প্রমাণ [Morphological Evidence]:-
জীবদেহের যে সমস্ত অঙ্গের বাহ্যিক গঠন ও কাজ আলাদা হলেও উত্পত্তি এবং অভ্যন্তরীণ গাঠনিক কাঠামো মূলগতভাবে [basically] এক, তাদের সমসংস্থ অঙ্গ বলে ।
বিভিন্ন প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গের প্রাথমিক গঠনগত মিল দেখে জৈব-বিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় । এগুলির মধ্যে মেরুদন্ডী প্রাণীদের অগ্রপদ, হৃতপিন্ড ও লুপ্তপ্রায় অঙ্গ ঘটিত সাদৃশ্য জৈব বিবর্তনের স্ব-পক্ষে উত্কৃষ্ট প্রমাণ, যেমন;
[1] অগ্রপদের সাদৃশ্য [Similarity in limbs]:- তিমি, ঘোড়া, পাখি, মানুষ ইত্যাদির অগ্রপদের অস্থির গঠনের তুলনা করলে তাদের মধ্যে একটি সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়, যেমন এদের প্রত্যেকের অগ্র বাহুই প্রায় একইরকম অস্থি দিয়ে গঠিত ।
যেমন : তিমির প্যাডেল, মানুষের হাত, বাদুড় ও পাখির ডানা, ঘোড়ার সামনের পা প্রভৃতি অঙ্গগুলি একই ভাবে উত্পত্তি লাভ করেছে । প্রত্যেকক্ষেত্রেই এইসব অঙ্গগুলি হিউমেরাস, রেডিয়াস ও আলনা, কারপ্যালস, মেটাকারপ্যালস ফ্যালানেজস ইত্যাদি হাড় নিয়ে গড়ে উঠেছে ।
এইসব অঙ্গের মধ্যে যেসব আপাত পার্থক্য দেখা যায় সেগুলি বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য ঘটেছে, যেমন : পাখির ও বাদুড়ের অগ্রপদ (ডানা) আকাশে উড়বার অঙ্গ; ঘোড়ার অগ্রপদ দৌড়বার উপযুক্ত, তিমির অগ্রপদ (প্যাডেল) সাঁতার কাটবার অঙ্গ এবং মানুষের অগ্রপদ (হাত) কোনও বস্তুকে ধরা অথবা সুক্ষ্ম কোনও কাজ করার উপযুক্ত অঙ্গ ।
এই সব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিভিন্ন রকম মেরুদন্ডী প্রাণী একই রকম পূর্বপুরুষ বা উদবংশীয় জীব থেকেই সৃষ্টি হয়েছে । সমসংস্থ অঙ্গগুলো অভিসারী বিবর্তনকেও নির্দেশ করে ।
[2] হৃৎপিন্ড ঘটিত সাদৃশ্য [Similarity in hearts]:- নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিভিন্ন জীবের কোনও অঙ্গের গঠন পর্যালোচনা করলে তাদের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়, একে তুলনামূলক শারীরস্থানীয় প্রমাণ বলা হয় । যেমন : মাছ, ব্যাঙ সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী —ইত্যাদি মেরুদন্ডী প্রাণীগোষ্ঠীর হৃৎপিন্ডের গঠনের তুলনা করলে দেখা যাবে যে, এরা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত । হৃৎপিন্ডের গঠন ও কার্যকারিতা মাছ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীদেহে ক্রমশ সরল থেকে জটিল হয়েছে । মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হৃৎপিন্ডের গঠন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে মাছের হৃৎপিন্ড দুই প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট, উভচরদের হৃৎপিন্ড তিন প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট, সরীসৃপদের নিলয়টি অর্ধবিভক্ত হয়েছে, যা পক্ষী ও স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত হয়ে চার প্রকোষ্ঠযুক্ত হৃৎপিন্ডের উদ্ভব হয়েছে । হৃৎপিন্ডের এই রকম ধারাবাহিকতা থেকে অনুমান করা যায় যে মাছ থেকে উভচর, উভচর থেকে সরীসৃপ এবং সরীসৃপ থেকে দুই ধারায় পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উদ্ভব হয়েছে ।
[i] মাছের হৃৎপিন্ড:- মাছের হৃৎপিন্ড দু'প্রকোষ্ঠযুক্ত, যেমন : একটি অলিন্দ ও একটি নিলয়, যা গঠনগত ভাবে খুবই সরল এবং জলে বাস করার উপযুক্ত ।
[ii] ব্যাঙের হৃৎপিন্ড:- ব্যাঙ উভচর প্রাণী ; এদের হৃৎপিন্ড তিন প্রকোষ্ঠযুক্ত, যেমন : দুটো অলিন্দ ও একটি নিলয় । তবুও মাছের মতো ব্যাঙের হৃৎপিন্ডে দূষিত এবং বিশুদ্ধ রক্তের মিশ্রণ ঘটে ।
[iii] সরীসৃপ প্রাণীর হৃৎপিন্ড:- সরীসৃপ শ্রেণিভুক্ত প্রাণীর হৃৎপিন্ড বেশি উন্নত ধরনের । এটি অসম্পূর্ণভাবে চার প্রকোষ্ঠযুক্ত, যেমন : দুটো অলিন্দ এবং অসম্পূর্ণভাবে বিভক্ত দুটো নিলয় নিয়ে গঠিত । এখানে দূষিত এবং বিশুদ্ধ রক্তের মিশ্রণ রোধ করার চেষ্টা দেখা যায় ।
[iv] পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হৃৎপিন্ড:- পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হৃৎপিন্ড সম্পূর্ণভাবে চার প্রকোষ্ঠযুক্ত যা দুটো অলিন্দ এবং দুটো নিলয় নিয়ে গড়ে উঠেছে, এর ফলে দূষিত রক্ত এবং বিশুদ্ধ রক্ত কখনই মিশতে পারে না ।
সুতরাং, মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃৎপিন্ড পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই প্রমাণিত হয় যে, এরা সকলেই একই পূর্বপুরুষ বা উদবংশীয় জীব থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং এদের অঙ্গগুলিও সরল থেকে ক্রমশ জটিল ও উন্নতমানের হয়েছে । হৃৎপিন্ডের তুলনামূলক শারীরস্থান থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে :
[i] সমস্ত জীব একই পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং
[ii] সরল জীব থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে জটিল জীবের উদ্ভব বা অভিব্যক্তি ঘটেছে ।
[3] নিষ্ক্রিয়, ক্ষয়িষ্ণু বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গঘটিত সাদৃশ্য [Similarity in Vestigial Organs]:- জীবদেহের যে সব অঙ্গ এককালে পূর্বপুরুষের দেহে সক্রিয় ছিল, কিন্তু ক্রমবিবর্তনের ফলে বর্তমান প্রজন্মে কর্মক্ষমতা হারিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোটো আকারের এবং কাজহীন অঙ্গে পরিণত হয়েছে, তাদের লুপ্তপ্রায় বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে ।
প্রাণীদের বিভিন্ন ক্ষয়িষ্ণু অঙ্গ পর্যবেক্ষণ করলেও জৈববিবর্তন সম্পর্কে ধারণা জন্মায় । যেমন : গিনিপিগের সক্রিয়া অঙ্গ 'সিকাম' মানুষের ক্ষেত্রে 'অ্যাপেন্ডিক্স' নামে নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে । বানরের সক্রিয় অঙ্গ লেজ মানুষের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় অঙ্গ কক্সিস -এ রুপান্তরিত । এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, সক্রিয় অঙ্গ বিশিষ্ট প্রাণী থেকে নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বিশিষ্ট প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে ।
প্রাণীদের মতো উদ্ভিদেরও লুপ্তপ্রায় অঙ্গের সন্ধান মেলে । ভূনিম্নস্থ কান্ডের শল্কপত্র, আম, কাজুবাদাম, কালকাসুন্দির বন্ধ্যা পুংকেশর বা স্ট্যামিনোড, শতমূলী উদ্ভিদের বন্ধ্যা গর্ভকেশর বা পিস্টিলোড লুপ্তপ্রায় অঙ্গ ।
এই সব ঘটনা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, নিষ্ক্রিয় অঙ্গযুক্ত জীব, ওই একই প্রকৃতির সক্রিয় অঙ্গযুক্ত পূর্বপুরুষ বা উদবংশীয় জীব থেকে সৃষ্টি হয়েছে ।
কয়েকটি নিষ্ক্রিয় অঙ্গের তালিকা
নিষ্ক্রিয় অঙ্গের নাম | যে অঙ্গের নিষ্ক্রিয় রূপ | যে জীবদেহে অবস্থিত |
1.ভার্মি ফর্ম অ্যাপেন্ডিক্স | সিকাম | মানুষ |
2. উপপল্লব | নিকটিটেটিং পর্দা | মানুষ |
3. কক্সিস | লেজ | মানুষ |
4. নিষ্ক্রিয় পশ্চাদপদ | সক্রিয় পশ্চাদ পদ | পাইথন |
5. নিষ্ক্রিয় ডানা | সক্রিয় ডানা | উটপাখি |
6. স্ট্যামিনোড | পুংকেশর | কালকা সুন্দি |
7. পিস্টিলোড | গর্ভকেশর | শতমুলি |
8. শল্ক পত্র | পাতা | ভূনিম্নস্থ কান্ড |
*****
- 10298 views