ডারউইনবাদের ব্যাখ্যা

Submitted by arpita pramanik on Sat, 12/22/2012 - 00:02

ডারউইনবাদের ব্যাখ্যা (Explanation of Darwinism) :

[1]  অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি [Prodigality of production]:- ডারউইনের মতে, অত্যাধিক হারে বংশবৃদ্ধি করাই জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য । এর ফলে জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । উদাহরণ : একটি স্ত্রী স্যালমন মাছ প্রজনন ঋতুতে প্রায় 3 কোটি ডিম পাড়ে । একটি ঝিনুক একবারে 12 কোটি ডিম্বাণু উৎপাদন করে । ডারউইনের মতে, একজোড়া হাতি থেকে উদ্ভূত সকল হাতি বেঁচে থাকলে 750 বছরে হাতির সংখ্যা হবে এক কোটি নব্বই লক্ষ (1,90,00,000) । উল্লেখযোগ্য যে, হাতি 12 বছরে মাত্র একটি সন্তান প্রসব করে ।

[2]  সীমিত খাদ্য ও বাসস্থান [Constancy of food and shelter]:- ভূপৃষ্ঠের আয়তন সীমাবদ্ধ হওয়ায় জীবের বাসস্থান এবং খাদ্যও সীমিত ।

[3]  অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম [Struggle for existance]:- জীবের জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় এবং খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়, ডারউইন এই ধরনের সংগ্রামকে 'অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম' বলে অভিহিত করেন । ডারউইন লক্ষ করেন যে, জীবকে তিনটি পর্যায়ে এই সংগ্রাম করতে হয়,  যেমন :

[i]  বিষমপ্রজাতির সঙ্গে সংগ্রাম [Interspecific struggle]:- যে-কোনও দুই বা ততোধিক প্রজাতির মধ্যে বাঁচার জন্য যে প্রতিযোগিতা ঘটে তাকে আন্তঃপ্রজাতির সংগ্রাম বলে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ব্যাঙ একদিকে কীট-পতঙ্গ ভক্ষণ করে, অন্যদিকে তেমনি ব্যাঙেরা সাপ কর্তৃক ভক্ষিত হয় । আবার, ময়ুর কর্তৃক ব্যাঙ ও সাপ উভয়েই ভক্ষিত হয় —এইভাবে নিতান্ত জৈবিক কারণেই বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে খাদ্যখাদক সম্পর্কযুক্ত একটি নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রাম গড়ে ওঠে ।

[ii]  স্বপ্রজাতির সঙ্গে সংগ্রাম [Intraspecific struggle]:-  একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের খাদ্য ও বাসস্থান একই রকমের হওয়ায় এদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়; যাকে অন্তঃপ্রজাতির সংগ্রাম বলে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে; একটি দ্বীপে তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা ততোধিক হারে বৃদ্ধি পেলে খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় । সবল প্রাণীগুলি দুর্বল প্রাণীদের প্রতিহত করে গ্রাসাচ্ছাদন করে, ফলে দুর্বল প্রাণীগুলি কিছুদিনের মধ্যেই অনাহারে মারা পড়ে ।

[iii]  প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম [Struggle against odd environment]:- বন্যা, খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রচন্ড বালিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুত্পাত প্রভৃতি প্রতিকূল পরিবেশ জীবের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে । সুতরাং জীবকে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য প্রতিনিয়ত এইসব প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয় । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, উত্তর ও মধ্য আমেরিকার কোয়েল পাখি প্রচন্ড ঠান্ডা ও তুষারপাতের ফলেই লুপ্ত হয়েছে ।

[4]  ভ্যারিয়েশান বা ভেদ বা প্রকারণ [Variation in the organism]:- ডারউইনের মতে, পৃথিবীতে যে কোনও দুটো জীব কখনই অবিকল একই রকমের হতে পারে না । অর্থাৎ জীবের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য বা ভেদ থাকবেই । এমনকি একই পিতা-মাতার সন্তানদের মধ্যেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । ডারউইন মনে করতেন অবিরত ত্রিবিধ সংগ্রামের ফলে জীবদেহে প্রকারণ বা পার্থক্যের সৃষ্টি হয় যা প্রজননকালে অপত্যের দেহে সঞ্চারিত হয় এবং পরিশেষে জীবের বৈশিষ্ট্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে । ডারউইনের ধারণা অনুযায়ী ছোটো ছোটো ধারাবাহিক পরিবর্তনই বিভিন্ন প্রজাতির উত্পত্তির জন্য দায়ী । আকস্মিক পরিবর্তনকে তিনি 'প্রকৃতির খেলা' [sports nature] বিবেচনা করে কোনো গুরুত্ব দেননি ।

[5]  যোগ্যতমের উদবর্তন [Survival of the fittest]:- ডারউইনের মতে যেসব প্রকারণ বা ভেদ জীবের জীবনসংগ্রামের পক্ষে সহায়ক এবং পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনমূলক, তারাই কেবল বেঁচে থাকবে এবং তাদের উদবর্তন ঘটবে । অন্যরা কালক্রমে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হবে । প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে কোনও একটি বিশেষ পরিবেশে একটি জীব বাঁচার অযোগ্য হলেও অন্য কোনও পরিবেশে সে বাঁচার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ছোটো লোমওয়ালা কুকুর কলকাতার গ্রীষ্মপ্রধান পরিবেশে বাঁচার উপযুক্ত হলেও মেরুপ্রদেশের জমাট শীতে বাঁচার অযোগ্য । একইভাবে মেরুপ্রদেশের বড়ো লোমওয়ালা কুকুর সেই দেশে বসবাসের যোগ্য হলেও কলকাতায় বসবাসের অযোগ্য ।

[6]  প্রাকৃতিক নির্বাচন [Natural selection]:- ডারউইন তত্ত্বের এই প্রতিপাদ্যটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ । "যে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় অনুকূল ভেদ বা অভিযোজনমূলক ভেদ সমন্বিত জীবেরা অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বেশি সুযোগ সুবিধে ভোগ করে, তাকে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে ।"  অনুকূল ভেদ সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হলে বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকে এবং অত্যাধিক হারে বংশবিস্তার করে । অপরপক্ষে, প্রতিকূল ভেদ সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হয় না বলে পরাজিত সৈনিকের মতো ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয় ।

[7]  নতুন প্রজাতির উৎপত্তি [Origin of new species]:- একটি বিশেষ জীবগোষ্ঠীর মধ্যে অনুকূল প্রকারণগুলি পুঞ্জিভূত হওয়ায় উদবংশীয় জীব ও উত্তরপুরুষের মধ্যে অনেক বেশি বৈসাদৃশ্য দেখা দেয় এবং এরই ফলে কালক্রমে একটি নতুন প্রজাতির উত্পত্তি ঘটে । বিবর্তনের ফলস্বরূপ জীবজগতে নতুন প্রজাতির জন্ম হয় ।

ডারউইনবাদ অনুসারে জিরাফের দীর্ঘ গ্রীবার অভিব্যক্তির ব্যাখ্যা ল্যামার্কবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ।  ডারউইনবাদ অনুযায়ী উদবংশীয় জিরাফের দলে বিভিন্ন গ্রীবা-দৈর্ঘ্য সমন্বিত জিরাফ বর্তমান ছিল । উঁচু ডালের পাতার নাগাল পাওয়ার জন্য দীর্ঘতম গ্রীবার উদবংশীয় জিরাফই প্রাকৃতিক নির্বাচনের আনুকূল্য পায় । দীর্ঘকাল প্রাকৃতিক নির্বাচনের আনুকূল্যে অভিযোজনমূলক বৈশিষ্ট্যটি একটি জনু থেকে অপর জনুতে সঞ্চারিত হয় এবং বহু জনুর পর সুদীর্ঘ গ্রীবা সমন্বিত জিরাফ দলের উত্পত্তি ঘটে । বর্তমানকালের জিরাফের মধ্যেও গ্রীবা-দৈর্ঘ্যের তারতম্য দেখা যায়, তবুও বর্তমানকালের সমস্ত জিরাফের গ্রীবা সুদীর্ঘ ।

*****

Related Items

টীকাকরণ এবং অনাক্রম্যতাকরণ

দেহে জীবাণু বা জীবাণুসৃষ্ট পদার্থ কৃত্রিমভাবে প্রবেশ করিয়ে ওই রোগের সাপেক্ষে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়াকে টীকাকরণ বলে, এবং যে পদার্থকে দেহে প্রবেশ করানো হয়, তাকে টীকা বলে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে অথবা খাওয়ানোর দ্বারা প্রতিষেধক টীকা দেহে প্রবেশ ...

সাধারণ জীবাণু নাশকের ব্যবহার

বিভিন্ন রোগ-জীবাণু প্রতিরোধের জন্য নানা ধরনের জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয় । সাধারণত জীবাণুনাশকগুলি প্রধানত তিন ধরনের হতে পারে, যেমন : প্রাকৃতিক, ভৌত এবং রাসায়নিক। সূর্যালোক এবং বাতাস স্বাভাবিক জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে । সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির ...

রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে সংক্রামিত রোগ সমূহ

কোনো রোগের কারণে অথবা ক্ষতের মাধ্যমে দেহ থেকে অতিরিক্ত রক্ত নির্গত হয়ে গেলে, রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে তা প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে । বর্তমানে বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক, নার্সিং হোম অথবা বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনের জন্য রক্ত পাওয়া যায় ...

পতঙ্গ বাহকের মাধ্যমে সংক্রামিত রোগসমূহ

রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের সংক্রমণের ধরন বিভিন্ন রকম হতে পারে । মানবদেহে খাদ্যের সাথে, জলের সাথে, বাতাসের মাধ্যমে, বিভিন্ন পতঙ্গ অথবা অপর জীবের দেহের সাথে সংলগ্ন হয়ে অথবা তাদের দংশনের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ হয় । এছাড়াও রোগাক্রান্ত অথবা প্রাণীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ...

প্রোটোজোয়া (Protozoa)

এককোশী আণুবীক্ষণিক প্রাণীদের প্রোটোজোয়া বা আদ্যপ্রাণী বলা হয় । আদ্যপ্রাণীদের মধ্যে কিছু প্রাণী মানবদেহে পরজীবীরূপে বসবাস করে এবং নানারকম রোগ সৃষ্টি করে । এখানে পাঠক্রমভুক্ত কয়েকটি আদ্যপ্রাণীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা হল - প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স