প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানগুলির গুরুত্ব

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 03/22/2020 - 23:15

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানগুলির গুরুত্ব আলোচনা কর:-

[Assess the importance of the literary sources for the study of ancient Indian history]

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা —সাহিত্যিক উপাদান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান । প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । সাহিত্যিক উপাদানগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে । যেমন— (১) দেশীয় সাহিত্য এবং (২) বৈদেশিক বিবরণী ।

(১) দেশীয় সাহিত্য:- প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে দেশীয় সাহিত্যের ভান্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ । ভারতীয় সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই দেশীয় সাহিত্যগুলির মধ্যে বৈদিক যুগের সাহিত্য, মহাকাব্য, পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র, ষড়দর্শন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ, সংস্কৃত সাহিত্য, জীবনচরিত, আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।

বৈদিক সাহিত্য— খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগের ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বৈদিক সাহিত্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । চতুর্বেদ অর্থাৎ ঋক, সম, যজুঃ ও অথর্ব বেদ থেকে আর্যদের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি নানা বিষয় সম্পর্কে জানা যায় । এ ছাড়া বৈদিক সমাজ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, অর্থনীতি প্রভৃতি জানতে সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, সূত্র সাহিত্য প্রভৃতিও যথেষ্ট সাহায্য করে । তাই প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে এদের মূল্য অস্বীকার করা যায় না ।

মহাকাব্য— বৈদিক সাহিত্যের পর রামায়ণ ও মহাভারত এই দুটি মহাকাব্যের কথা বলা যায় । এই মহকাব্য দুটির আনুমানিক রচনাকাল হল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে । প্রাচীনকালের বিভিন্ন রাজকাহিনী, আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের সংঘর্ষের কাহিনী, দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতার বিস্তার, সমকালীন সামাজিক অবস্থা প্রভৃতি জানার কাজে মহাকাব্য দুটি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে খুবই সহায়তা করে থাকে ।

পুরাণ— বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে অনেক তথ্যের জন্য অষ্টাদশ পুরাণের অন্তর্গত মৎস্যপুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, কর্মপূরাণ, মার্কন্ডেয়পুরাণ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য । এগুলিতে তৎকালীন বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান, রাজবংশ তালিকা, রাজার রাজত্বকাল, ভৌগোলিক পরিচিতি প্রভৃতি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায় ।

স্মৃতিশাস্ত্র— প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় আদর্শ ও সামাজিক বিধানগুলির ইতিহাস জানতে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি খুবই সহায়তা করে থাকে । স্মৃতিশাস্ত্রগুলির মধ্যে মনু-স্মৃতি, নারদ-স্মৃতি, বৃহস্পতি-স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি, কাত্যায়ন-স্মৃতি প্রভৃতি পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজ ও ধর্মীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান । তৎকালীন ধর্ম, সম্পত্তি, উত্তরাধিকার আইন, সামাজিক বিধিনিষেধ প্রভৃতি জানতে এগুলি সহায়তা করে ।

ষড়দর্শন— প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ষড়দর্শন যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ । ষড়দর্শনের মধ্যে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈদেশিক, পূর্ব-মীমাংসা, উত্তর-মীমাংসা প্রভৃতি থেকে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি, সমাজ সংগঠন, জাতি বিচার, রাষ্ট্রীয় কর্তব্য প্রভৃতি জানা যায় ।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ — প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত । মহাকাব্যের যুগের পরবর্তীকালের ইতিহাস রচনার জন্য বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলির মূল্য অপরিসীম । বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থের মধ্যে ত্রিপিটক অর্থাৎ বিনয় পিটক, সুত্ত পিটক ও অভিধর্ম পিটক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়া, জাতক, দীপবংশ, মহাবংশ, আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প, ললিতবিস্তার, বুদ্ধচরিত প্রভৃতি যথেষ্ট মূল্যবান গ্রন্থ । জৈন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে দ্বাদশ অঙ্গ, জৈন কল্পসূত্র, জৈন ভগবতী সূত্র, আচারাঙ্গ সূত্র, পরিশিষ্ট পার্বণ, প্রবন্ধচিন্তামণি, প্রবন্ধকোষ প্রভৃতি সমকালীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে জানার উল্লেখযোগ্য উপাদান ।

সংস্কৃত সাহিত্য— প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিদ্যা, আইন প্রভৃতি বিষয়ক বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থও বিশেষভাবে সাহায্য করে । এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গার্গীসংহিতা । এটি একটি জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ হলেও মাঝে মাঝে সাল তারিখের গ্রন্থিমোচনে সাহায্য করে থাকে । ভাসের চারুদত্ত, পাণিনি-র অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থটি বেদের ভাষাগত বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব চতুথ শতকের শেষদিকে রচিত হয় । বৈদিক যুগের পরবর্তী সময়ের তথ্যাদি জানতে এই গ্রন্থ সাহায্য করে থাকে । পতজ্ঞলির মহাভাষ্য গ্রন্থটি মৌর্য পরবর্তী শুঙ্গদের সম্পর্কে বিশেষত ব্যাকট্রীয় গ্রিকদের ভারত আক্রমণ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে থাকে । বাৎসায়নের কামসূত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম, রাঘুবংশম এবং মালবিকাগ্নিমিত্রম, বিশাখদত্তের দেবীচন্দ্রগুপ্তম, মুদ্রারাক্ষস প্রভৃতি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ ।

রাজ-বৃত্তান্ত ও জীবনচরিত— প্রাচীনকালের বিভিন্ন রাজ-বৃত্তান্ত ও জীবনীগ্রন্থ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপাদান । বাণভট্টের হর্ষচরিত, বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, জয়সিংহের কুমারপালচরিত, পদ্মগুপ্তের নবসাহসাঙ্কচরিত, বাকপতিরাজের গৌড়বাহ, চাঁদবরদৈ-এর পৃথ্বীরাজ চরিত প্রভৃতি গ্রন্থ সমকালীন রাজবংশের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এই জীবনীগ্রন্থগুলি সাধারণের বোধগম্য সহজ, সরলভাষায় রচিত হয় নি । নিজেদের কবিত্বশক্তির পরিচয় দেওয়াই এই লেখকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল । তাঁরা তাঁদের প্রভুদের মনোরঞ্জন করতে চেয়েছিলেন । তাই এই রচনাগুলি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট ।    

আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ প্রাচীনকালে আঞ্চলিকভাবে লিখিত কিছু ইতিহাস গ্রন্থও পাওয়া যায়, যেগুলি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য । এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — কলহনের রাজতরঙ্গিনী । এর রচনাকাল খ্রীষ্টীয় ১১৪৯-৫০ অব্দে । এতে কাশ্মীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে । ভারতীয় সাহিত্যে এটিকেই প্রথম ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া হয় । এখানে লেখক ইতিহাস রচনার মূলনীতি, ভয়লেশহীন দৃষ্টিভঙ্গী ঘোষণা করেছেন । এছাড়াও সোমেশ্বরের রাসমালা ও কীর্তিকৌমুদী যাতে গুজরাটের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে । অরিসিংহের সুকৃতিসংকীর্তন, মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধচিন্তামণি, নন্দিক কলম্বকম ও কলিঙ্গত্তু-পরাণি প্রভৃতি গ্রন্থগুলিতে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে ।

বৈদেশিক বিবরণী প্রাচীনকালে বিভিন্ন সময় ধর্ম, বাণিজ্য, ভ্রমণ, রাজ্যজয় প্রভৃতি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পর্যটক ভারতে এসেছিলেন এবং তাঁরা অনেকেই তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে গিয়েছেন যা আজকের দিনে ইতিহাস রচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । এর মধ্যে গ্রিক, রোমান, চৈনিক, তিব্বতীয়, আরবি প্রমুখ পর্যটকদের বিবরণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।

গ্রিক বিবরণ— আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পূর্ববর্তী গ্রীক লেখকদের মধ্যে দুটি নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য । একটি হেরোডোটাস ও অপরটি টেসিযাস । হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয় । তিনি কখনো ভারতে না এলেও তাঁর রচিত গ্রন্থ 'Persae' বা ইতিহাসমালা থেকে আমরা পারসিকগণ কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণ ও অধিকারের কথা জানতে পারি । টেসিয়াসের ইন্ডিকা নামক গ্রন্থও সমকালীন ভারতের নানা তথ্যে সমৃদ্ধ । আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় তার তিন অভিযান-সঙ্গী নিযারকাস, এরিস্টোবুলাস এবং ওনেসিক্রিটাসের রচনায় । সিসিলির ডায়োডোরাস রচিত বিবলিওথেকা হিস্টোরিকা, এরিয়ানের আনাবাসিস, জাস্টিনের এপিটোম, প্লুটার্ক-এর আলেকজান্ডারের জীবনী প্রভৃতি গ্রন্থে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় । গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে ভারতে এসেছিলেন । তাঁর লেখা ইন্ডিকা গ্রন্থটি সমকালীন ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল । পলিবায়াসের সাধারন ইতিহাস থেকে ভারতের বাহ্লিক গ্রিক আক্রমণের কথা জানা যায় । এ ছাড়া, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে জনৈক গ্রিক নাবিকের লেখা 'পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সী' বা ভারত মহাসাগরে ভ্রমণ, এবং টলেমির ভূগোল থেকে তৎকালীন ভারতের ব্যবসাবাণিজ্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় ।

রোমান বিবরণ  রোমান লেখক কুইন্টাস কার্টিয়াসের রচনায় আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায় । প্লিনির প্রাকৃতিক ইতিহাস থেকে সমকালীন সমুদ্রপথ এবং ভারতের সঙ্গে রোম ও গ্রিসের ব্যবসাবাণজ্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় l

চৈনিক ও তিব্বতীয় বিবরণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের প্রথম দিকের জন্য গ্রীক গ্রন্থসমূহের মত, চীনের ইতিবৃত্ত শেষের দিকের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ । চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে ভারতে এসে এদেশে দীর্ঘদিন, প্রায় ১৫ বৎসর অতিবাহিত করেন । তাঁর রচিত ফো-কুয়ো-কি একটি মূল্যবান গ্রন্থ । হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের আমলে ভারতে এসেছিলেন এবং তাঁর রচিত সি-ইউ-কি নামক গ্রন্থে তাঁর ভারত ভ্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন । এ ছাড়া, ইৎ সিং-এর ভারতে বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত বিবরণী এবং ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তিব্বতীয় ইতিহাসবিদ লামা তারকনাথের ভারতে বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক উপাদান ।

আরবীয় বিবরণ— অনেক আরব পর্যটক ভারতে এসেছেন ও তাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন । তাঁদের লেখা বিবরণী থেকে ভারতে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিবরণ পাওয়া যায় । এ প্রসঙ্গে সুলেমান, আল মাসুদি, আল বিলাদুরি, হাসান নিজামি, আল-বেরুনি প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । সুলেমান নবম শতকে পাল রাজ দেবপালের রাজত্বের শেষদিকে আসেন ও ৮৫১ সালে একটি ভারত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন । আল মাসুদি ৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মহীপালের রাজত্বকালে প্রতিহার রাজ্যে আসেন । আরবীয় পর্যটকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন পন্ডিত আল-বিরুনী । তিনি ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদের সঙ্গে ভারতে আসেন । ১০৩০ সালে প্রকাশিত তাঁর তহকিক-ই-হিন্দ গ্রন্থে তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুদের ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার কথা বিশদ ভাবে জানা যায় ।

দেশীয় সাহিত্যের উপাদানের ত্রুটি :- বৈদিক সাহিত্য মোটেই ইতিহাস গ্রন্থ নয় । তাই এখান থেকে তথ্য সংগ্রহের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে । মহাকাব্য দুটিতে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যেগুলি অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট । পুরাণগুলিতে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন লোককাহিনী ও কিংবদন্তি এমনভাবে মিশে গেছে যে তা থেকে সাবধানে তথ্য সংগ্রহ না করলে অনেক ক্ষেত্রে তথ্য পরিবেশনে ভুল হতে পারে । রাজাদের জীবনীগ্রন্থগুলি অনেক সময় রাজার সভাসদরা লিখতেন বলে তাতে রাজার কৃতিত্ব সম্পর্কে অতিরঞ্জন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছুই নয় ।

বৈদেশিক বিবরণীর সীমাবদ্ধতা:-

(১) ভারতের সঙ্গে সংযোগের অভাব— বিদেশি পর্যটকরা ভারতে খুব বেশিকাল কাটাননি বা তাঁরা ভারতের ভাষা, রীতিনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন না । তাই তাঁদের রচনার ভিত্তি দুর্বল ।

(২) জনশ্রুতি— অনেক সময় বিদেশি পর্যটকরা লোকমুখে শোনা কথা বা কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে তাঁদের বিবরণ রচনা করায় গল্পকাহিনীতে পরিণত হয়েছে ।

(৩) পক্ষপাতিত্ব — নিরপেক্ষতা ছেড়ে বিদেশি পর্যটকরা অনেক সময় নির্দিষ্ট শাসকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন ।

উপসংহার — বিভিন্ন সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সমন্বয়ে প্রাচীন ভারতের ধারাবাহিক যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাস রচিত হয়েছে । তবে সাহিত্যিক উপাদানগুলি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জনের হাতে পড়ে নানা সময়ে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে । তাই সাহিত্যিক উপাদানগুলি ব্যবহারের সময় খুবই সচেতন থাকতে হয় । কোনো সাহিত্যিক উপাদানের তথ্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের দ্বারা সমর্থিত হলে তা নিশ্চিত উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা যায় । সাহিত্যিক উপাদানের এই ত্রুটি দূর করার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে অসুবিধা নেই ।

***

Comments

Related Items

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপকরণ হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব

প্রাচীন ভারতের কোনো লিখিত ইতিহাস এ পর্যন্ত পাওয়া না যাওয়ায় দেশি ও বিদেশি ঐতিহাসিকরা বহু পরিশ্রম করে বিভিন্ন উপকরণ থেকে তিল তিল করে ঐতিহাসিক তথ্যাদি সংগ্রহ করে প্রাচীন ভারতের একটি লিখিত ইতিহাস কোনো রকমে খাড়া করেছেন ।

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের বা পতনের কারণ

হরপ্পা সভ্যতা ছিল এক বিশাল প্রাণবন্ত সভ্যতা এবং এই প্রাণবন্ত সভ্যতা কি কারণে বিলুপ্ত হয়েছিল, তা সঠিক ভাবে জানা যায় না । দীর্ঘ ছয়শো বছর উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত অস্তিত্বের পর আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের কিছুকাল পরে এই সভ্যতার অবসান ঘটেছিল একথা সর্বজনস্বীকৃত ।

মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বিবরণ দাও (Maurya Administration)

কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা' বৌদ্ধগ্রন্থ 'দিব্যবদান' বিশাখদত্তের 'মুদ্রারাক্ষস' নাটক, জৈনগ্রন্থ 'পরিশিষ্টপার্বণ' পতাঞ্জলির 'মহাভাষ্য' প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে, অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি থেকে এবং শাকরাজা রুদ্রদামনের জুনাগড় প্রশস্তি থেকে মৌর্য শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায় ।

গুপ্ত যুগকে ভারতের ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন ?

প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে গুপ্ত রাজাদের শাসনকাল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় । গ্রিক ইতিহাসে সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে যেমন পেরিক্লিসের যুগকে সুবর্ণযুগ বলা হয় তেমনই গুপ্ত যুগকে ভারত ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় ।

গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতভেদের কারণ

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতভেদের কারণ ছিল কিছুটা ব্যক্তিগত ও কিছুটা মতাদর্শগত । সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজীর প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে শ্রদ্ধাশীল হলেও কংগ্রেসে তার ডিক্টেটরসুলভ কর্তৃত্ব ও সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর আপসধর্মী মনোভাব তিনি পছন্দ করতেন না ।