দুই বোন --- পৃষ্ঠা-১৭

Submitted by administrator on Fri, 04/27/2012 - 00:57
দুই বোন ছোটো বড়ো সমস্ত অধিবাসীর একটিমাত্র সাধনার বিষয়। মানুষটি নিরতিশয় নিরুপায় এবং দেহযাত্রানির্বাহে শোচনীয়ভাবে অকর্মণ্য, এই সংস্কার কোনোমতেই শর্মিলার মন থেকে ঘুচতে চায় না। হাসিও পায়, অথচ মনটা স্নেহসিক্ত হয়ে ওঠে, যখন দেখে চুরটের আগুনে ভদ্রলোকের আস্তিন খানিকটা পুড়েছে, অথচ লক্ষ্যই নেই। ভোরবেলায় মুখ ধুয়ে শোবার ঘরের কোণের কলটা খুলে রেখে এঞ্জিনিয়র কাজের তাড়ায় দৌড় দিয়েছে বাইরে, ফিরে এসে দেখে মেজে জলে থই-থই করছে, নষ্ট হয়ে গেল কার্পেটটা। এই জায়গায় কলটা বসাবার সময়ে গোড়াতেই আপত্তি করেছিল শর্মিলা। জানত এই পুরুষটির হাতে বিছানার অদূরে ঐ কোনাটাতে প্রতিদিন জলে-স্থলে একটা পঙ্কিল অনাসৃষ্টি বাধবে। কিন্তু মস্ত এঞ্জিনিয়র, বৈজ্ঞানিক সুবিধার দোহাই দিয়ে যতরকম অসুবিধাকে জটিল করে তুলতেই ওর উৎসাহ। খামকা কী মাথায় এল একবার, নিজের সম্পূর্ণ ওরিজিনাল প্ল্যানে একটা স্টোভ বানিয়ে বসল। তার এ দিকে দরজা, ও দিকে দরজা; এ দিকে একটা চোঙ, ও দিকে আর-একটা; এক দিকে আগুনের অপব্যয়হীন উদ্দীপন, আর-এক দিকে ঢালু পথে ছাইয়ের নিঃশেষে অধঃপতন--তার পরে সেঁকবার ভাজবার সিদ্ধ-করবার জল-গরমের নানা আকারের খোপখাপ, গুহাগহ্বর, কলকৌশল। কলটাকে উৎসাহের ভঙ্গিতে ও ভাষাতেই মেনে নিতে হয়েছিল, ব্যবহারের জন্যে নয়, শান্তি ও সদ্‌ভাব-রক্ষার জন্যে। প্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের এই খেলা! বাধা দিলে অনর্থ বাধে, অথচ দুদিনেই যায় ভুলে। চিরদিনের বাঁধা ব্যবস্থায় মন যায় না, উদ্ভট একটা-কিছু সৃষ্টি করে, আর স্ত্রীদের দায়িত্ব হচ্ছে মুখে ওদের মতে সায় দেওয়া এবং কাজে নিজের মতে চলা। এই স্বামী-পালনের দায় এত দিন আনন্দে বহন করে এসেছে শর্মিলা।

এত কাল তো কাটল। নিজেকে বিবর্জিত করে শশাঙ্কের জগৎকে শর্মিলা কল্পনাই করতে পারে না। আজ ভয় হচ্ছে মৃত্যুর দূত এসে জগৎ আর জগদ্ধাত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায় বুঝি বা। এমন-কি, ওর আশঙ্কা যে, মৃত্যুর পরেও শশাঙ্কের দৈহিক অযত্ন শর্মিলার বিদেহী আত্মাকে শান্তিহীন করে রাখবে। ভাগ্যে ঊর্মি ছিল। সে ওর মতো শান্ত নয়। তবু ওর হয়ে কাজকর্ম চালিয়ে নিচ্ছে। সে কাজও তো মেয়েদের হাতের কাজ। ঐ স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শ না থাকলে পুরুষদের প্রতিদিনের জীবনের প্রয়োজনে রস থাকে না যে, সমস্তই যে কিরকম শ্রীহীন হয়ে যায়। তাই ঊর্মি যখন তার সুন্দর হাতে ছুরি নিয়ে আপেলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে রাখে, কমলালেবুর কোয়াগুলিকে গুছিয়ে রাখে সাদা পাথরের থালার এক পাশে, বেদানা ভেঙে তার দানাগুলিকে যত্ন করে সাজিয়ে দেয়, তখন শর্মিলা তার বোনের মধ্যে যেন নিজেকেই উপলব্ধি করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকে সর্বদাই কাজের ফরমাশ করছে।

ওর সিগারেট-কেসটা ভরে দে-না, ঊর্মি।

দেখছিস নে ময়লা রুমালটা বদলাবার খেয়াল নেই?

ঐ দেখ্‌, জুতোটা সিমেণ্টে বালিতে জমে নিরেট হয়ে রয়েছে। বেহারাকে সাফ করতে হুকুম করবে তার হুঁস নেই।

বালিশের ওয়াড়গুলো বদলে দে-না, ভাই।

ফেলে দে ঐ ছেঁড়া কাগজগুলো ঝুড়ির মধ্যে।

একবার আপিস-ঘরটা দেখে আসিস তো ঊর্মি, আমি নিশ্চয় বলছি ওঁর ক্যাশবাক্সের চাবিটা ডেস্কের উপর ফেলে রেখে বেরিয়ে গেছেন।

ফুলকোপির চারাগুলি তুলে পোঁতবার সময় হল, মনে থাকে যেন।

মালীকে বলিস গোলাপের ডালগুলো ছেঁটে দিতে।

ঐ দেখ্‌ কোটের পিঠেতে চুন লেগেছে -- এত তাড়া কিসের, একটু দাঁড়াও-না--ঊর্মি, দে তো বোন, বুরুশ ক’রে।

ঊর্মি বই-পড়া মেয়ে, কাজ-করা মেয়ে নয়, তবু ভারি মজা লাগছে। যে কড়া নিয়মের মধ্যে সে ছিল তার থেকে বেরিয়ে এসে কাজকর্ম সমস্তই ওর কাছে অনিয়মের মতোই ঠেকছে। এই সংসারের কর্মধারার ভিতরে ভিতরে যে উদ্‌বেগ আছে, সাধনা আছে, সে

Related Items

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৩২

দুই বোন

“শর্মি, ভেবো না আমি কাপুরুষ। দায়িত্ব ফেলে পালাব আমি, এত অধঃপতন কল্পনা করতেও পার?”

শর্মিলা কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললে, “কী হয়েছে আমাকে বুঝিয়ে বলো।”

শশাঙ্ক বললে, “আবার ঋণ করেছি তোমার কাছে, সে কথা ঢাকা দিয়ো না।”

শর্মিলা বললে, “আচ্ছা, বেশ।”

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৩১

দুই বোন করে আমাকে লুকিয়ে পাথুরে কয়লার হাটে তেজিমন্দি খেলা শুরু করলে। চড়ার বাজারে যা কিনেছে সস্তার বাজারে তাই বেচে দিতে হল। হঠাৎ আজ দেখলে হাউইয়ের মতো ওর সব গেছে উড়ে পুড়ে, বাকি রইল ছাই। এখন ভগবানের কৃপায় নেপালে কাজ পেলে তোমাদের ভাবতে হবে না।”

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৩০

দুই বোন

নার্স বাইরে থেকে বললে, “ডাক্তারবাবু এসেছেন।”

শর্মিলা বললে, “ডেকে দাও।”

কথাটা বন্ধ হয়ে গেল।

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-২৯

দুই বোন

এ কথা দিদি বার বার করে ঊর্মিকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তার অবর্তমানে সব চেয়ে যেটা সান্ত্বনার বিষয় সে ঊর্মিকে নিয়েই। এ সংসারে অন্য কোনো মেয়ের আবির্ভাব কল্পনা করতেও দিদিকে বাজত, অথচ শশাঙ্ককে যত্ন করবার জন্যে কোনো মেয়েই থাকবে না এমন লক্ষ্মীছাড়া অবস্থাও দিদি মনে মনে সইতে পারত না। ব্যাবসার

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-২৮

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : শশাঙ্ক

দুই বোন | ২৮