জায়গিরদারি সংকট ও আঞ্চলিক বিদ্রোহ

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 09/12/2014 - 11:11

জায়গিরদারি সংকট ও আঞ্চলিক বিদ্রোহ (Complications of Jaigirdar and Local rebellions)

জায়গিরদারি সংকট (Complications of Jaigirdar) : ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটলেও তাঁর সময় থেকেই পতনের প্রক্রিয়া সূচিত হয় । জায়গিরদারি সংকট ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ । ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই সংকট তীব্রতর হয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের আমলে একটানা যুদ্ধ ও বিশেষত তাঁর ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি এই সংকটের মূল কারণ ছিল । শুধু যুদ্ধের খরচ নয়, শাসকশ্রেণির বিলাস বৈভবের জন্যও প্রচুর অর্থব্যয় হত । ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়েনি । বরং শাসকশ্রেণির আয় কমেছিল । আসলে যুদ্ধের প্রয়োজনে ঔরঙ্গজেবকে দরাজ হাতে মনসব বাড়াতে হয় । মনসবদারদের সংখ্যা অবশ্য শাহজানের আমল থেকেই বাড়ছিল । জাহাঙ্গীরের সময়ে মনসবদারের সংখ্যা ছিল ২০৬৯; শাহজাহানের সময়ে ৮০০০ এবং ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষে ১১,৪৬৫ । কিন্তু মনসবদারদের সংখ্যা বাড়লেও জমির পরিমাণ সমানুপাতিক হারে বাড়ে নি । ঔরঙ্গজেবের আমলে সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়লেও দাক্ষিণাত্যের জমি ছিল অনুর্বর । কাজেই উত্তর ভারতের জমির চাহিদা বেশি ছিল । এদিকে মনসবদারদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়বার ফলে তাদের জন্য জমি বা জায়গিরে টান পড়ে । ভালো জায়গিরের জন্য মনসবদারদের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হত । এর ফলেই দেখা দেয় অভিজাত শ্রেণির অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং পারস্পরিক বিরোধ । ভালো জায়গিরের জন্য যে কাড়াকাড়ি এবং তার ফলে উদ্ভুত যে পরিস্থিতি, তাকেই বলা হয় জায়গিরদারি সংকট । স্বয়ং ঔরঙ্গজেব সমস্যাটির ব্যাপকতা উপলব্ধি করে মন্তব্য করেছিলেন— “ইয়েক আনার সদ বিমার” । অর্থাৎ একটি বেদনা ও একশো জন রোগী । এই অবস্থায় অনেক মনসবদারই তাদের মনঃপুত জায়গির না পাওয়ায় বা তাদের বেতন প্রাপ্ত জায়গির থেকে তোলা কার্যত অসম্ভব বুঝে কৃষকদের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দেয় এবং তা জোরজবরদস্তি করে তুলতে থাকতেন । এর অনিবার্য পরিণতি ছিল প্রজাপীড়ন । এই অবস্থায় কৃষি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ চাষবাস আর লোভনীয় ছিল না, তেমনই কৃষক অসন্তোষ দিকে দিকে কৃষক বিদ্রোহের জন্ম দেয় ।

আঞ্চলিক বিদ্রোহ (Local rebellions) : ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত ও অনুদার নীতি এবং কৃষক অসন্তোষের ফলে ব্যাপক ভাবে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয় । এইসব গণ বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট ও চরিত্র অবশ্য সব জায়গায় এক রকম ছিল না । রাজপুত বিদ্রোহের ক্ষেত্রে এর কারণ ছিল উত্তরাধিকার সমস্যা ও ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত রাজপুত নীতি । মারাঠাদের ক্ষেত্রে ছিল স্বাধীনতার প্রশ্ন । জাঠ ও সতনামি বিদ্রোহের পিছনে ছিল কৃষক অসন্তোষ । শিখ বিদ্রোহের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রশ্নও ছিল প্রধান কারণ । আবার আফগান বিদ্রোহের প্রেরণা ছিল উপজাতীয় স্বার্থ । অনেক ক্ষেত্রে আবার পরের দিকে এইসব গণঅভ্যুত্থান স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল । কারণ যাই হোক না কেন, একের পর এক এইসব আঞ্চলিক বিদ্রোহের আগুনে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায় । কৃষক অসন্তোষ ও বিদ্রোহ ঔরঙ্গজেবের আমলেই প্রথম হয়নি, কিন্তু তাঁর আমলে এইসব বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ও ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশী । কৃষক বিদ্রোহকে কেবলমাত্র ঔরঙ্গজেবের অনুদার ও সংকীর্ণ ধর্মনীতির পরিণতি হিসাবেই বিশ্লেষণ করা সঙ্গত নয় । এইসব বিদ্রোহ দমন করতে ঔরঙ্গজেবকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল ।

*****

Related Items

ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কারণ ও তার ফলাফল

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে একটি বড়ো কারণ ছিল পুঁজির জোগান । এই পুঁজির অনেকটাই এসেছিল ঔপনিবেশিক ব্যবসাবাণিজ্য থেকে । ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে দুটি সমস্যা দেখা দেয় ...

ইউরোপীয় ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি

ভারত ইতিহাসে ইংরেজ শাসনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার । কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মানদণ্ড অচিরেই রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল । আগে যেসব বহিরাগত জাতি ভারতে এসেছিল, তাদের সঙ্গে ...

দেওয়ানি লাভ ও দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব

বক্সারের যুদ্ধে ত্রিশক্তির পরাজয়ের পর প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে ইংরেজদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । এই অবস্থায় ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে বাংলায় ক্লাইভের পুনরাগমন ঘটে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের এলাহাবাদ চুক্তিতে ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কারা ও এলাহাবাদ ছাড়া ...

বক্সারের যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব

কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুটি, মুঙ্গের ও উদয়নালায় পরপর ছয়টি যুদ্ধে মিরকাশিম পরাজিত হন । এই অবস্থায় ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মিরকাশিমকে সিংহাসনচ্যুত করে ইংরেজরা মিরজাফরকে আবার বাংলার মসনদে বসান । কিন্তু মিরকাশিম হাল না ছেড়ে মুঘল সম্রাট শাহ আলম ...

মির কাশিম (Mir Kasim)

কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ এবং বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টোগ্রামের জমিদারি প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মিরকাশিম বাংলার মসনদ লাভ করেন । ইংরেজদের সাহায্যে বাংলার মসনদ দখল করলেও তিনি ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ ছিলেন না, বরং বাস্তববাদী ছিলেন । অহেতুক ইংরেজ বিরোধিতা তাঁর ...