নেহেরু রিপোর্ট ও এর মূল্যায়ন

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 07/13/2018 - 21:14

নেহেরু রিপোর্ট ও এর মূল্যায়ন [Nehru Report and its evaluation]:-

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মৌতে সর্বদলীয় সন্মেলনের পূর্ণ অধিবেশনে নেহেরু কমিটির প্রধান মতিলাল নেহেরু সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করেন । এই খসড়া সংবিধানই নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত । এই রিপোর্টে অবিলম্বে ভারতকে স্বায়ত্তশাসন বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস-এর মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হয় । এই সময় ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের দাবিগুলি অগ্রাহ্য করে এবং নির্মম দমন নীতির আশ্রয় নেয় ।

মতিলাল নেহেরুর রিপোর্ট ভারতের সব দল ও মতকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি ‌। সংক্ষেপে এটি ভারতের জন্য একটি সর্বসম্মত সংবিধানের খসড়া তৈরি করতে ব্যর্থ হয় । এই ব্যর্থতার বহু কারণ ছিল । যে সর্বদলীয় সম্মেলনের ওপর সংবিধানটি রচনার ভার ন্যস্ত হয় তার সদস্যেরা নানা দল ও মতাদর্শের সমর্থক হওয়ায় তাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি । নেহেরু রিপোর্ট সম্পর্কে কংগ্রেসের বেশ কিছু তরুণ সদস্যও ভিন্নমত পোষন করেছিলেন । তাদের নেতৃস্থানীয় ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহেরু । নেহেরু রিপোর্ট dominion status দাবী করেছিল অন্যদিকে তরুণ ব্যক্তিবর্গ পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন । মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের বিরোধিতা নেহেরু রিপোর্ট-এর মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় । জিন্নাহ হিন্দুদের সঙ্গে আপস রফার জন্য অধিকাংশ মুসলমান নেতাকে কয়েকটি শর্তে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিত‍্যাগ করে যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি করান । শর্তগুলি হলো -

(১) কেন্দ্রীয় আইন সভায় মুসলমান প্রতিনিধিদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হবে । 

(২) ভারতে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার বদলে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে ।

(৩) পাঞ্জাব ও বাংলায় জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাদেশিক আইনসভায় প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করা হবে ।

(৪) সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে পরিণত করা হবে । 

(৫) সমস্ত প্রদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য আইন সভা গুলিতে আসন সংরক্ষিত থাকবে ।

1927 সালের মে মাসে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি ও 1927 সালের ডিসেম্বরে মাদ্রাজে কংগ্রেস মহম্মদ আলী জিন্নাহর এইসব দাবি মেনে নেয় । কিন্তু মতিলাল নেহেরু ও তেজ বাহাদুর সপ্রু যারা নেহেরু রিপোর্টটি তৈরি করেন তারা প্রধানত হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দের চাপে মহম্মদ আলী জিন্নাহর অধিকাংশ দাবি অগ্রাহ্য করেন । এতে মহম্মদ আলী জিন্নাহ স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হন । কিন্তু হতাশ না হয়ে তিনি 1928 সাল অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সর্বদলীয় সম্মেলনের শেষ বৈঠকে তার পুরানো দাবিগুলির কিঞ্চিৎ রদবদল করে আবার পেশ করেন । এই সম্মেলনেই তিনি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার স্বার্থে তার দাবীগুলি মেনে নেওয়ার জন্য আবেদন জানান । সুমিত সরকার একে বলেছেন ' a passionate plea for unity' । তিনি বলেন, 'We are all sons of this land. We have to live together ..... Believe me, there is no progress for India until the Muslims and Hindus are united' ।

প্রধানত হিন্দু মহাসভার নেতা জয়াকরের তীব্র আপত্তিতে মতিলাল নেহেরুরা মহম্মদ আলী জিন্নাহ'র দাবিগুলো মেনে নিতে অস্বীকার করেন । তখন মহম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের কট্টর গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলান ও ১৪ দফা দাবির (Fourteen Points) কথা ঘোষণা করেন । এতে ছিল জিন্নাহর পুরনো দাবিগুলির সঙ্গে প্রদেশ গুলির পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রবর্তন ।

এরপরই শুরু হয়ে যায় হিন্দুদের ব্যাপারে মুসলমানদের aloofness এবং positive hostility । বিশেষ করে গান্ধীজীর আইন অমান্য আন্দোলনের সময় এটা সকলেরই চোখে পড়ে । সর্বদলীয় সম্মেলন কর্তৃক জয়াকর তথা হিন্দু মহাসভার দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়াকে 'parting of ways' বলেছেন । সুমিত সরকার বলেন Hindu communalism had significantly weakened the national anti-imperialist cause at a critical moment' । মহম্মদ আলী জিন্নাহ একমাত্র পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা বর্জন করলেও তাঁর অন্যান্য দাবি থেকে একচুল নড়তে রাজি হননি । সুতরাং উভয়পক্ষের অর্থাৎ মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও হিন্দু মহাসভার গোয়ার্তুমি নেহেরু রিপোর্টের ভরাডুবির জন্য দায়ী ছিল । সুমিত সরকারও নেহেরু রিপোর্ট-এর কিছু প্রশংসা করেছেন । তার মতে ভারতের জন্য একটি 'constitutional framework' -এর খসড়া তৈরি করার জন্য রিপোর্টটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।

এটি ভারতের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিটি কি রকম হওয়া উচিত তা দেখিয়েছিল । খসড়া সংবিধানটিতে কেন্দ্র ও প্রদেশ গুলির মধ্যে ক্ষমতার বন্টন, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সার্বজনীন ভোটাধিকার, দায়িত্বশীল সরকার, জনগণের ১৯ টি মৌলিক অধিকার, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার অধিকার, কোন ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনরূপ সম্পর্ক না রাখা প্রভৃতির উল্লেখ ছিল । সুমিত সরকার বলেন পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত কোন সংবিধানেই স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয়নি ।

মজার ব্যাপার হল --ব্রিটিশ সরকার বরাবরই ভারতের জাতীয়তাবাদীদের 'Elitist politicians বলে ব্যঙ্গ করত ও নিজেকে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর বলে প্রচার করত । এই 'Elitist politician' রাই জনগণের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার দাবি করেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার কখনো এর ধারে কাছেও যায়নি । এই প্রসঙ্গে বলা উচিত শুধু মুসলিম লীগই নয় ব্রিটিশ সরকার শিখ ও খ্রিষ্টানরা, মাদ্রাজের অব্রাহ্মণ দল, ডঃ আম্বেদকরের অনুন্নত গোষ্ঠী প্রভৃতি নেহেরু রিপোর্ট এর বিরোধিতা করেছিল ।

অন্যদিকে বেশ কিছু মুসলিম নেতা All India Liberally Federation, বেশ কিছু সংখ্যাগোষ্ঠী নেহেরু রিপোর্টের প্রতি সমর্থন জানায় । জাতীয় কংগ্রেসও, নেহেরু রিপোর্টকে সানন্দে গ্রহণ করে । মুসলমানদের বিরোধিতায় ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত পুলকিত হয় । ভারত সচিব ভাইকাউন্ট পীল ভারতের বড়লাট লর্ড আরউইনকে মুসলমানদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করতে বলেন । সুতরাং ব্রিটিশ সরকারের 'Divide and Rule' নীতিরই জয় হল ।

 

Comments

Related Items

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপকরণ হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব

প্রাচীন ভারতের কোনো লিখিত ইতিহাস এ পর্যন্ত পাওয়া না যাওয়ায় দেশি ও বিদেশি ঐতিহাসিকরা বহু পরিশ্রম করে বিভিন্ন উপকরণ থেকে তিল তিল করে ঐতিহাসিক তথ্যাদি সংগ্রহ করে প্রাচীন ভারতের একটি লিখিত ইতিহাস কোনো রকমে খাড়া করেছেন ।

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের বা পতনের কারণ

হরপ্পা সভ্যতা ছিল এক বিশাল প্রাণবন্ত সভ্যতা এবং এই প্রাণবন্ত সভ্যতা কি কারণে বিলুপ্ত হয়েছিল, তা সঠিক ভাবে জানা যায় না । দীর্ঘ ছয়শো বছর উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত অস্তিত্বের পর আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের কিছুকাল পরে এই সভ্যতার অবসান ঘটেছিল একথা সর্বজনস্বীকৃত ।

মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বিবরণ দাও (Maurya Administration)

কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা' বৌদ্ধগ্রন্থ 'দিব্যবদান' বিশাখদত্তের 'মুদ্রারাক্ষস' নাটক, জৈনগ্রন্থ 'পরিশিষ্টপার্বণ' পতাঞ্জলির 'মহাভাষ্য' প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে, অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি থেকে এবং শাকরাজা রুদ্রদামনের জুনাগড় প্রশস্তি থেকে মৌর্য শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায় ।

গুপ্ত যুগকে ভারতের ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন ?

প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে গুপ্ত রাজাদের শাসনকাল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় । গ্রিক ইতিহাসে সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে যেমন পেরিক্লিসের যুগকে সুবর্ণযুগ বলা হয় তেমনই গুপ্ত যুগকে ভারত ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় ।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানগুলির গুরুত্ব

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা —সাহিত্যিক উপাদান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান । প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । সাহিত্যিক উপাদানগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে । যেমন— (১) দেশীয় সাহিত্য এবং (২) বৈদেশিক বিবরণী ।