গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতভেদের কারণ

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 07/24/2018 - 21:25

গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতভেদের কারণ:-

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতভেদের কারণ ছিল কিছুটা ব্যক্তিগত ও কিছুটা মতাদর্শগত । সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজীর প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে শ্রদ্ধাশীল হলেও কংগ্রেসে তার ডিক্টেটরসুলভ কর্তৃত্ব ও সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর আপসধর্মী মনোভাব তিনি পছন্দ করতেন না । উভয়ই ছিলেন সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, নিজ নিজ মতাদর্শে অটল । ফলে তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়া করা প্রায় অসম্ভব ছিল । উভয়ের মতাদর্শও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন । মহাত্মা গান্ধী আপসপন্থী ও অহিংসা পদ্ধতির অনুসারী । তিনি ছিলেন বামপন্থার বিরোধী । অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন আপসবিরোধী ও প্রয়োজনে সহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ।

সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন বামপন্থী মনোভাবাসম্পন্ন । গান্ধীজী ব্রিটিশ বিরোধী হলেও ব্রিটিশ সরকারের ঘোর বিপদে তাকে অসুবিধায় ফেলতে চাইতেন না । নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে কোনোরূপ সম্পর্ক রাখতে তাঁর ছিল ঘোর অনীহা ।

অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র বসু শত্রু দেশ ব্রিটেনের বিপদের সময়ই তাকে নির্মম আঘাত হানার কথা বলেছিলেন । ব্রিটেনকে কাবু করার জন্য তিনি নাৎসিবাদী জার্মানী ও ফ্যাসিবাদী ইটালীর সঙ্গে হাত মেলাতেও রাজি ছিলেন । কৌটিল্যের সুবিখ্যাত নীতি — শত্রুর শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত— তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল ।

১৯২২ সাল থেকেই সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজীর নীতি ও কার্যকলাপের সমালোচনা করে আসছিলেন । তিনি ১৯৩৩ সালে গান্ধীজির নেতৃত্বকে ব্যর্থ বলেছিলেন । সুভাষচন্দ্র বসুর বামপন্থী ভাবমূর্তি, নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের দিকে ঝোঁক ও অহিংস আন্দোলনের কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয় মহাত্মা গান্ধীকে ধীরে ধীরে সুভাষ-বিরোধী করে তোলে । হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসু সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান । তাঁর এই ভাষণে সাম্যবাদী আদর্শের দিকে ঝোঁক সুস্পষ্ট । এতে মহাত্মা গান্ধী ও তার অনুগামী দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীরা রুষ্ট হয়েছিলেন ও সুভাষচন্দ্র বসু বিড়লা প্রমুখ শিল্পপতিদের বিরাগভাজন হয়ে দাঁড়ান ।

মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বসু বামপন্থীদের সাহায্য নিয়ে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান ও মহাত্মা গান্ধীর মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সিতারামাইয়াকে পরাজিত করেন । এর ফলে মহাত্মা গান্ধী সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর আরও বিরূপ হন । সুভাষচন্দ্র বসু মহাত্মা গান্ধীকে বৃদ্ধ, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞ, ব্যাপক গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পক্ষে অনুপযুক্ত প্রভৃতি বলে তাঁকে মর্মান্তিক আঘাত হানেন । ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠীর ধারণা সুভাষচন্দ্র বসু দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে তাঁদের সঙ্গে আপসরফার পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন । কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃবর্গ ও মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগিতার ফলে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের ত্রিপুরীতে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে ব্যর্থ হন ।

মহাত্মা গান্ধী সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর হন । আসলে সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজির নেতৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, তাঁর নীতি ও কার্যধারাকে সমুলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন বলেই মহাত্মা গান্ধী তাঁকে ছুঁড়ে ফেলতে কৃতসংকল্প হয়েছিলেন । সুভাষচন্দ্র বসু বুঝতে পারেননি যে, কংগ্রেসের অবিসংবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কংগ্রেসে থাকা যায় না । মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র বসুর মতাদর্শ ও আন্দোলনের পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য এতটাই ছিল যে, তা মিটিয়ে ফেলা কার্যত অসম্ভব ছিল ।

***

Comments

Related Items

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপকরণ হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব

প্রাচীন ভারতের কোনো লিখিত ইতিহাস এ পর্যন্ত পাওয়া না যাওয়ায় দেশি ও বিদেশি ঐতিহাসিকরা বহু পরিশ্রম করে বিভিন্ন উপকরণ থেকে তিল তিল করে ঐতিহাসিক তথ্যাদি সংগ্রহ করে প্রাচীন ভারতের একটি লিখিত ইতিহাস কোনো রকমে খাড়া করেছেন ।

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের বা পতনের কারণ

হরপ্পা সভ্যতা ছিল এক বিশাল প্রাণবন্ত সভ্যতা এবং এই প্রাণবন্ত সভ্যতা কি কারণে বিলুপ্ত হয়েছিল, তা সঠিক ভাবে জানা যায় না । দীর্ঘ ছয়শো বছর উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত অস্তিত্বের পর আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের কিছুকাল পরে এই সভ্যতার অবসান ঘটেছিল একথা সর্বজনস্বীকৃত ।

মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বিবরণ দাও (Maurya Administration)

কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা' বৌদ্ধগ্রন্থ 'দিব্যবদান' বিশাখদত্তের 'মুদ্রারাক্ষস' নাটক, জৈনগ্রন্থ 'পরিশিষ্টপার্বণ' পতাঞ্জলির 'মহাভাষ্য' প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে, অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি থেকে এবং শাকরাজা রুদ্রদামনের জুনাগড় প্রশস্তি থেকে মৌর্য শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায় ।

গুপ্ত যুগকে ভারতের ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন ?

প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে গুপ্ত রাজাদের শাসনকাল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় । গ্রিক ইতিহাসে সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে যেমন পেরিক্লিসের যুগকে সুবর্ণযুগ বলা হয় তেমনই গুপ্ত যুগকে ভারত ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলা হয় ।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানগুলির গুরুত্ব

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা —সাহিত্যিক উপাদান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান । প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । সাহিত্যিক উপাদানগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে । যেমন— (১) দেশীয় সাহিত্য এবং (২) বৈদেশিক বিবরণী ।