মুন্ডা বিদ্রোহ (Munda Rebellion):- বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাঁচিসহ ছোটোনাগপুর অঞ্চলে এবং তৎসংলগ্ন মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা ও বাংলার একাংশে মুন্ডা উপজাতিরা বসবাস করত । ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রাঁচিতে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে এক শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে যা 'মুন্ডা বিদ্রোহ' বা 'উলগুলান' বা বিরাট বিশৃঙ্খলা (Great Tumult) নামে পরিচিত ।
দীর্ঘদিন ধরে মুন্ডা উপজাতিরা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে জমি চাষ-আবাদ করে আসছিল । তাদের এই জমির যৌথ মালিকানাভিত্তিক চাষপ্রথার নাম ছিল খুন্তকট্টি বা খুঁৎকাঠি । ভারতে কোম্পানির শাসন শুরু হলে চিরাচরিত খুন্তকট্টি বা খুঁৎকাঠি প্রথা বাতিল করে মুন্ডাদের বসবাস অঞ্চলটি সেখানকার জায়গিরদার, ঠিকাদার, বণিক ও মহাজন শ্রেণির দখলে চলে যায় । ব্রিটিশের নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার দরুন মুন্ডাদের ওপর ভূমিরাজস্ব অধিক হারে চাপানো হয় । তাদের জমিগুলির যৌথ মালিকানার বদলে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হয় । উত্তরের সমভূমিতে আগত ঠিকাদার, মহাজন ও জমিদার শ্রেণি 'ভূঁইহারি' জমি থেকে মুন্ডাদের তাড়িয়ে দিয়ে সেগুলি নিজেদের 'মাঝিহাম' বা খাসজমিতে পরিণত করে । জমিদার ও মহাজনরাও মুন্ডাদের ওপর নানা ধরনের উচ্চ হারে সুদ ও করের বোঝা চাপায় । সেই সঙ্গে মুন্ডাদের বেঠবেগারি অর্থাৎ বিনা পারিশ্রমিকে নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য করত । লুথারান ও অ্যাঙ্গলিকান মিশনারিরা মুন্ডারি ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাতে থাকে । খ্রিস্টান মিশনারিরা নানা প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে মুন্ডাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছিল । ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের চিরাচরিত মুন্ডারি আইন ও সামাজিক বিধিব্যবস্থা বাতিল করে নতুন আইনবিধি চালু করে । সবমিলিয়ে মুন্ডাদের জীবনযাত্রার ছন্দপতন ঘটলে তারা বিদ্রোহের পথে যায় ।
বিপন্ন মুন্ডাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বিরসা মুন্ডা নিজেকে ভগবানের দূত হিসেবে প্রচার শুরু করেন । বিরসা এক নতুন ধর্ম প্রচার করে মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করেন । তিনি মুন্ডাদের খাজনা দিতে নিষেধ করেন এবং বিদেশিদের বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়ে এক স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলে ১৮৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে দুই বছর জেলে থাকতে হয় । ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর মুন্ডারা বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । খুঁটি, রাঁচি, চক্রধরপুর, বুন্দু, তামার, তোরপা, কারা বাসিয়া প্রভৃতি স্থানে তাঁরা গোপন ঘাঁটি গড়ে তোলে । ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে । বিদ্রোহী মুন্ডারা ইংরেজ কর্মচারী, পুলিশ, জমিদার, মহাজন, পাদরি, ঠিকাদারদের আক্রমণের নিশানা করে । তারা চার্চ এবং পুলিশ থানাগুলিতে আক্রমণ চালায় । মুন্ডারা ছোটোনাগপুরের পুরোনো রাজধানী দইসাতে নতুন মুন্ডা রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে । প্রবল বিক্রমে লড়াই করে বিদ্রোহী মুন্ডারা শেষপর্যন্ত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় । বিরসা মুন্ডাকে গ্রেপ্তার করে এই বিদ্রোহের অবসান ঘটানো হয় । বহু বিদ্রোহীর ফাঁসি ও কারাদন্ড হয় । বিরসা মুন্ডা রাঁচি জেলে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ।
মুন্ডা বিদ্রোহের তীব্রতায় ব্রিটিশ সরকার তাদের অভাব-অভিযোগগুলির সমাধান করতে বাধ্য হয় । ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস হয় । এই আইনের মাধ্যমে কৃষকপ্রজাদের খুন্তকট্টি বা খুঁৎকাঠি প্রথা অর্থাৎ জমির যৌথ মালিকানা প্রথা স্বীকার করে নেওয়া হয় । মুন্ডাদের নিজস্ব জমি থেকে উচ্ছেদ করা ও তাদেরকে বেগার খাটানো নিষিদ্ধ করা হয় । বিদ্রোহের শেষে মুন্ডাদের মধ্যে 'বিরসা সম্প্রদায়' নামে এক উপজাতি শাখা আত্মপ্রকাশ করে এবং মুন্ডারা বিরসা মুন্ডাকে 'বিরসা ভগবান' রূপে পুজো করা শুরু করে ।
বৈশিষ্ট্য :মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল —
(১) অরণ্যের অধিকার নিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে বিরোধিতা ।
(২) মুন্ডা বিদ্রোহ এক অন্যতম উপজাতি বিদ্রোহ যার মধ্যে ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজসংস্কার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল ।
(৩) বহিরাগতরা মুন্ডাদের প্রথাগত অধিকারগুলির ওপর হস্তক্ষেপ করে । তাই মুন্ডারা তাদের ঐতিহ্য নির্ভর অধিকারগুলির রক্ষার জন্য মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় ।
(৪) বিদ্রোহীদের মনে ধারণা জন্মায় যে ব্রিটিশ প্রশাসনের আইনকানুন ও আদালতের ওপর নির্ভর করা অর্থহীন ।
(৫) খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে । তারা নিজেদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে ।
(৬) খেরওয়ার (সাঁওতালদের আদি উপজাতি) ধর্মসংস্কার আন্দোলন বিরসা মুন্ডা ও তার অনুগামীদের প্রভাবিত করে । ফলে মুন্ডাদের ধর্মচিন্তা ও সমাজসংস্কার প্রভাবিত হয় ।
(৭) মুন্ডা উপজাতিদের বিদ্রোহ ছিল এক অর্থে কৃষক বিদ্রোহ । দরিদ্র মুন্ডা কৃষকরাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান চালিকাশক্তি । নরহরি কবিরাজ মুন্ডা বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন ।
******