ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement) : ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ হল ‘নবজাগরণ’ । আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন । ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী শাহ সৈয়দ আহমদ । তিনি আরবের ওয়াহাবিদের অনুকরণে ধর্মসংস্কারের কথা প্রচার করতে শুরু করেন । উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন দিল্লীর খ্যাতনামা মুসলিম নেতা সন্ত ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র আজিজ । প্রথম দিকে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ । ওয়াহাবি আন্দোলন মূলত ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণত হয় । সৈয়দ আহমদ বলেন, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্ব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে, একে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে । এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা । ওয়াহাবিগণ দ্রুত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন । ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে শিখ শাসনের অবসান ঘটাবার জন্য তাঁরা ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ওয়াহাবিগণ পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজধানী পেশোয়ার জয় করেন । কিন্তু তাদের এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি । ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ প্রাণ হারান এবং ওয়াহাবিরা পরাস্ত হন । পাঞ্জাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার ওয়াহাবিগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন । ক্রমশ বাংলা, বিহার, মীরাট ও অন্ধ্রের হায়দরাবাদে ওয়াহাবি আন্দোলন বিস্তারলাভ করে ।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement in Bengal):- বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমির । তিতুমিরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রাম বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয় । তিনি কিছুদিন মুসলিম তীর্থস্থান মক্কায় অবস্থান করেন । সেইখানেই তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন । তিতুমির তার অনুগামীদের ওয়াহাবি আদর্শ মেনে বলেন পির-পয়গম্বরকে মানার প্রয়োজন নেই, মন্দির, মসজিদ তৈরির প্রয়োজন নেই, ফয়েতা বা শ্রাদ্ধশান্তি অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই, অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে, সুদে টাকা খাটানো নিষিদ্ধ কাজ । তিতুমির ও তার অনুগামীরা অন্যান্যদের ওয়াহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত করতে শুরু করেন । কৃষ্ণদেব রায়ের জমিদারি পুঁড়া গ্রামে তিতুমিরের জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি বৃদ্ধি পায় । তিতুমির প্রথমে ওই গ্রামে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় । এতে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবিদের কাছ থেকে বলপূর্বক জরিমানা আদায় করতে শুরু করেন । ওয়াহাবিদের কর্তৃত্ব খর্বের জন্য তিনি ওয়াহাবিদের দাড়ি রাখার ওপর আড়াই টাকার কর ধার্য করেন । তা ছাড়াও কৃষ্ণদেব রায় আদেশ দিয়ে বলেন তাঁর জমিদারি এলাকার মধ্যে ওয়াহাবি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলে পাকা ইটের তৈরি বাড়ির ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা ও কাঁচা মাটির বাড়ির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা কর আদায় করা হবে । এতে তিতুমির ও তাঁর অনুগামীরা ক্ষিপ্ত হন । কর আদায়কে কেন্দ্র করে তিতুমিরের অনুগামীদের সঙ্গে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের লোকজনদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে । তিতুমির নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে ২৪ পরগনা জেলার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে জনসাধারণের অর্থ সাহায্যে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে নিজের মতো স্থানীয় প্রশাসন চালাতে থাকেন । এই প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মইনুদ্দিন বিশ্বাস, সেনাপতি হন তিতুমিরের ভাগ্নে গোলাম মাসুম এবং মিস্কিন শাহকে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় । তিতুমির এখান থেকে জমিদার, নীলকর এমনকি বারাসাত থেকে বসিরহাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চলা কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন । তিতুমির সুদখোর মহাজন, নীলকর, জমিদারদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র ও মুসলমানদের নিয়ে সংগঠন তৈরি করে । জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিতুমীরের প্রচারের ফলে দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির বহু মুসলমান দলে দলে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । প্রথম প্রথম ওয়াহাবিদের সংগ্রাম ছিল স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে । কলকাতার পূর্ব ও উত্তরদিকের গ্রামসমূহ, চব্বিশ পরগনা, নদীয, যশোহর, রাজশাহি, ঢাকা, ফরিদপুর, মালদহ ইত্যাদি স্থানে তিতুমির অনুগামীরা জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা শুরু করে । জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তিতুমিরের বিবাদকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাদের বিবাদ বাধে । তিতুমিরের নির্দেশে প্রজারা জমিদারদের খাজনা বয়কট করে । বিদ্রোহীরা দারোগা রামরতন চক্রবর্তীকে হত্যা করে । জমিদার ও নীলকররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তিতুমিরের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্ট জানায় ।
তিতুমিরকে দমনের জন্য গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দশম পদাতিক বাহিনী পাঠান । তিতুমীরকে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । তিতুমীর তাঁর ৬০০ অনুগামী কাঁচা বেল, ইট, তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে বাঁশের কেল্লা থেকে ব্রিটিশদের উপর আঘাত হানে । ইংরেজ সেনাবাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ভেঙে যায় । ইংরেজ বাহিনী তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীদের পরাজিত করেন । শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর এই সংঘর্ষে তিতুমীর তাঁর বহু অনুগামীসহ যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন । তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুম খাঁ ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন । তাঁকে কেল্লার সামনেই ফাঁসি দেওয়া হয় । এরপর বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান ঘটে । প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় আরও ঘোরতর ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন ।
তিতুমিরের নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে অনেকে জমিদার-বিরোধী বা ব্রিটিশবিরোধী বা হিন্দুবিরোধী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলিম দরিদ্র কৃষকশ্রেণি একযোগে জমিদার ও নীলকর বিরোধিতা থেকে ব্রিটিশ বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়ে যায় । এই আন্দোলনের সুবাদে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে ভারতে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ওয়াহাবি আন্দোলন কখনই জাতীয় আন্দোলন ছিল না এবং এই আন্দোলনের চরিত্র সাম্প্রদায়িকতা মুক্তও ছিল না । ইংরেজ শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ।
বৈশিষ্ট্য : তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর 'মেসিয়ানিক' (Messianic) চরিত্র । ইতিহাসে এমন এক সময় আসে যখন অসহায় নির্যাতিতরা এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন অতিমানবের আবির্ভাব প্রার্থনা করেন । অসহায় শ্রেণির মনে এক ধারণা জন্মায় যে এই সর্বশক্তিমান নেতাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা এই পৃথিবীর কোনো মানুষের নেই । এই ধরনের অপরিসীম ক্ষমতাসম্পন্ন নেতাকেই বলা হয় 'মেসিয়ানিক' নেতা এবং তার পরিচালিত আন্দোলনকে বলা হয় 'মেসিয়ানিক' আন্দোলন ।
******