অ্যালকেন (Alkane)

Submitted by arpita pramanik on Sat, 04/20/2013 - 23:38

অ্যালকেন (Alkane) :

যে সব হাইড্রোকার্বনে কার্বন পরমাণুগুলি পরস্পর কেবলমাত্র সমযোজী এক বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে, তাদের অ্যালকেন বলে । এদের গঠনে শুধু কার্বন-কার্বন একবন্ধন (C — C) এবং কার্বন-হাইড্রোজেন একবন্ধন (C — H) থাকে । অ্যালকেনগুলি কার্বন ও হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত মুক্ত শৃঙ্খল যৌগ ও এর অ্যালকেন অণুগুলি সম্পৃক্ত ।  অ্যালকেনের সাধারণ সংকেত CnH2n+2 (যেখানে n একটি ধনাত্বক পূর্ণসংখ্যা) । যদি n = 1 হয়, তাহলে CH4 (মিথেন) । যদি n = 2 হয়, তাহলে ইথেন (C2H6) । আবার যদি n = 3 হয়, তাহলে প্রপেন (C3H8) ।

মিথেন (Methane)

অ্যালকেন শ্রেণির প্রথম সভ্য হল মিথেন (CH4) । যাবতীয় জৈব যৌগের মধ্যে সরলতম যৌগ হল মিথেন । 1856 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী বার্থেলো পরীক্ষাগারে সর্বপ্রথম কার্বন ও হাইড্রোজেন থেকে মিথেন নামে জৈব যৌগটি প্রস্তুত করেন ।  

উৎস : বদ্ধ জলাভূমিতে জৈব যৌগের (উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ) ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিয়োজনের ফলে মিথেন উৎপন্ন হয় । এই গ্যাসটি মার্শ গ্যাস নাম পরিচিত । ডোবা পুকুরের পাড়ে বসে থাকলে বুদবুদ আকারের মিথেন গ্যাস বেরোতে দেখতে পাওয়া যায় । প্রাকৃতিক গ্যাসে প্রচুর পরিমাণে মিথেন আছে, কয়লাখনিতে বিস্ফোরণের কারণই হল মিথেন । পেট্রোলিয়াম খনির প্রাকৃতিক গ্যাসে প্রায় 85% মিথেন থাকে । পরীক্ষাগারে শুষ্ক সোডিয়াম অ্যাসিটিটের সঙ্গে সোডালাইম মিশিয়ে উত্তপ্ত করলে মিথেন উৎপন্ন হয় । বিক্রিয়াটি হল : CH3COONa + NaOH = CH4↑ + Na2CO3  ।

[i] আলেয়া (Will-O-the-wisp) : বদ্ধ জলাভূমিতে উদ্ভিদ পদার্থের জৈব যৌগের ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিয়োজনের ফলে মিথেন উৎপন্ন হয়, আবার অনেক সময় প্রাণীদেহের বিয়োজনের ফলে ফসফিন (PH3), ডাই-ফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড (P2H4) জলাভূমিতে উৎপন্ন হয় । তাই জলাভূমিত যে মিথেন উৎপন্ন হয় তার সঙ্গে অনেক সময় ফসফিন ও ডাই-ফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড (P2H4) মিশে থাকে । (P2H4) বায়ুতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে ওঠে । ডাই-ফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড (P2H4) -এর বায়ুতে দহনের ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা মিথেনকে নীলাভ শিখায় জ্বলতে সাহায্য করে । ফলে বিচরণশীল আলোক শিখাই হল আলেয়া (Will-O-the wisp) । তাই বদ্ধ জলাভূমিতে বা শ্মশানে অনেক সময় আলেয়া দেখা যায় । আলেয়া কোনো ভৌতিক ঘটনা নয়, এটি একটি স্বভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা ।

[ii] মিথেনের প্রধান উৎস হল প্রাকৃতিক গ্যাস, যে গ্যাসে মিথেনের পরিমাণ প্রায় 45 — 96% । প্রাকৃতিক গ্যাস তেলের কূপ থেকে পাওয়া যায় ।

[iii] কয়লা খনিতে যে গ্যাস পাওয়া যায় তার মধ্যে মিথেন থাকে এবং খুবই দাহ্য যার ফলে কয়লা খনিতে বিস্ফোরণ ঘটে ।

[iv] কোল গ্যাসের মধ্যেও প্রায় 32—50% মিথেন থাক ।

মিথেনের ব্যবহার (Uses of Methane):

[i] মিথেনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয় । প্রতি মোল মিথেন গ্যাস পোড়ালে প্রায় 213 কিলো ক্যালোরি তাপ উৎপন্ন হয় । 

[ii] মিথেনের অসম্পূর্ণ দহনের ফলে কার্বন ব্ল্যাক পাওয়া যায় । এই কার্বন ব্ল্যাক পেন্টস ও ছাপার কালি প্রস্তুতে, জুতার কালি প্রস্তুতে, কার্বন-কাগজ, টাইপ রাইটারের ফিতায় এবং রাবার শিল্পে, মোটর গাড়ির চাকার জন্য ব্যবহৃত হয় ।

[iii] মিথেন থেকে অনেক রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- মিথাইল অ্যালকোহল, মিথাইল ক্লোরাইড, ক্লোরোফর্ম, মিথিলিন ক্লোরাইড, ফরম্যালডিহাইড, মিথানল, অ্যাসিটিলিন প্রভৃতি যৌগ প্রস্তুত করা হয় ।

[iv] মিথেনকে ব্যবহার করে শিল্প পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন গ্যাস প্রস্তুত করা হয় । অ্যামোনিয়ার সংশ্লেষণের জন্য এইভাবে হাইড্রোজেন পাওয়া যায় ।

তাপ উৎপাদন ছাড়াও মিথেনকে বর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদার্থের উৎস হিসাবে ব্যবহার করা হয়

রাসায়নিক ধর্ম (Chemical Properties of Methane) :

[ক] অক্সিজেনে দহন (Burning in oxygen) :- মিথেন অপরের দহনে সহায়তা করে না কিন্তু নিজে দাহ্য । বায়ুতে বা অক্সিজেনে মিথেন অদীপ্ত ফিকে নীলাভ শিখায় জ্বলে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জল উৎপন্ন করে ।

কয়লা খনির গ্যাসেও মিথেন থাকে । তাই কয়লাখনিতে মাঝে মাঝে বিস্ফোরণ ঘটে । 

মিথেনের দহনে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়, তাই মিথেনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ।

[খ] মিথেনের প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া (Substitution reaction of methane) :- অ্যালকেন মৌলগুলি সম্পৃক্ত মুক্ত শৃঙ্খল যৌগ । সম্পৃক্ত জৈব যৌগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতিস্থাপন বিক্রিয়াতে অংশ গ্রহণ করা । বিক্ষিপ্ত সূর্যালোকে ক্লোরিনের সঙ্গে মিথেনের প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া ঘটে । ক্লোরিন দ্বারা মিথেনের হাইড্রোজেন পরমাণু একটি একটি করে প্রতিস্থাপিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে মিথাইল ক্লোরাইড, মিথিলিন ক্লোরাইড, ক্লোরোফর্ম ও কার্বন টেট্রাক্লোরাইড উৎপন্ন করে । এখানে প্রথম ধাপটি দেখানো হল ।

 

মিথেন একটি গ্রিন হাউস গ্যাস (Mention that CH4 is a Greenhouse Gas) : ভূপৃষ্ঠে অনেক গ্যাসীয় পদার্থ আছে যারা সূর্য রশ্মিকে পৃথিবীতে আপতিত হতে বাধা দেয় না । কিন্তু উত্তপ্ত ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অবলোহিত বিকিরণকে মহাশূন্যে চলে যেতে বাধা দেয় । ওই দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকিরণকে ওই গ্যাসগুলি শোষণ করে ভুমন্ডলের উষ্ণতা বজায় রাখে । কিন্তু ওই গ্যাসগুলির পরিমাণ যদি বেড়ে যায়, তাহলে পরিমন্ডলের উষ্ণতাও বাড়তে থাকবে । সেই অতিরিক্ত অবলোহিত রশ্মি শোষক গ্যাসগুলির মধ্যে মিথেন অন্তর্ভুক্ত, তার ফলে পরিবেশে উষ্ণতাও ভীষণভাবে বেড়ে যাবে । এক কথায় গ্লোবাল ওয়ার্মিং (Global warming) ঘটে । তাই মিথেন গ্যাসটিকে গ্রিন হাউস গ্যাস বলে । গ্রিন হাউস এফেক্টে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরেই মিথেনের (CH4) স্থান । বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস এফেক্টে মিথেনের অবদান 15-20 শতাংশ । প্রতি অণু মিথেনের তাপ আটকে দেওয়ার ক্ষমতা CO2 এর ক্ষমতার তুলনায় 25 গুণ বেশি । পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ত্যক্ত মিথেনের মোট পরিমাণের 14% হল ভারতের অবদান ।

*****

Related Items

জৈব যৌগগুলির প্রাথমিক শ্রেণিবিভাগ

কার্যকরী মূলকের ওপর ভিত্তি করে জৈব যৌগগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যথা - হাইড্রোকার্বন, অ্যালকোহল, অ্যালডিহাইড, কিটোন, কার্বক্সিলিক অ্যাসিড যৌগ । নীচে জৈব যৌগের কয়েকটি শ্রেণি এবং প্রতিটি শ্রেণির প্রথম তিনটি সদস্যের নাম ও গঠন দেওয়া হল ...

জৈব যৌগের কার্যকরী মূলক বা পরিচায়ক শ্রেণি

অসংখ্য জৈব যৌগকে, ওদের রাসায়নিক ধর্মের ওপর ভিত্তি করে কতকগুলি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে । দেখা যায় যে, এই রকম প্রতিটি শ্রেণিতে যৌগগুলির মধ্যে একটি বিশেষ মূলক বর্তমান থাকে । এই মুলকের উপস্থিতির জন্য ওই শ্রেণির সমস্ত যৌগের রাসায়নিক ধর্ম প্রায় একই রকম হয় ...

জৈব যৌগের বন্ধন প্রকৃতি

কর্বনের পারমাণবিক সংখ্যা 6, কার্বনের ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে জানা যায় কার্বনের প্রথম কক্ষে 2টি এবং বাইরের কক্ষে 4টি ইলেকট্রন আছে । কার্বন পরমাণু বাইরের কক্ষের 4টি ইলেকট্রন, অন্য পরমাণুর বাইরের কক্ষের ইলেকট্রনের সঙ্গে চারটি ইলেকট্রন জোড় গঠন করে সমযোজ্যতা দ্বারা জৈব ...

জীবজ অণু (Biomolecules)

সজীব কোশে সংশ্লেষিত ক্ষুদ্র অণু ও বৃহদ অণুকে একত্রে জীবজ অণু বলা হয় । প্রায় সমস্ত জীবজ অণুই কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, নিউক্লীয়িক অ্যাসিড, লিপিড এই চারটি শ্রেণির কোনো একটির অন্তর্ভুক্ত । এগুলি কোশের জীবজ পলিমার । কার্বোহাইড্রেট সরল সুগারের ...

জীবনক্রিয়ায় জৈব যৌগের ভুমিকা

প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহের বেশির ভাগ অংশ জৈব যৌগ দিয়ে গঠিত । তাই জীব জগতে জৈব যৌগের দান অতুলনীয় । জীবন ক্রিয়ার সঙ্গে জৈব যৌগ গভীর ভাবে জড়িত । জীবদেহের জীবনক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য জৈব যৌগের ভূমিকা অপরিসীম । জীবজগতে প্রত্যেক জৈবিক ক্রিয়ার কারণ ...