অ্যালকেন (Alkane) :
যে সব হাইড্রোকার্বনে কার্বন পরমাণুগুলি পরস্পর কেবলমাত্র সমযোজী এক বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে, তাদের অ্যালকেন বলে । এদের গঠনে শুধু কার্বন-কার্বন একবন্ধন (C — C) এবং কার্বন-হাইড্রোজেন একবন্ধন (C — H) থাকে । অ্যালকেনগুলি কার্বন ও হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত মুক্ত শৃঙ্খল যৌগ ও এর অ্যালকেন অণুগুলি সম্পৃক্ত । অ্যালকেনের সাধারণ সংকেত CnH2n+2 (যেখানে n একটি ধনাত্বক পূর্ণসংখ্যা) । যদি n = 1 হয়, তাহলে CH4 (মিথেন) । যদি n = 2 হয়, তাহলে ইথেন (C2H6) । আবার যদি n = 3 হয়, তাহলে প্রপেন (C3H8) ।
মিথেন (Methane)
অ্যালকেন শ্রেণির প্রথম সভ্য হল মিথেন (CH4) । যাবতীয় জৈব যৌগের মধ্যে সরলতম যৌগ হল মিথেন । 1856 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী বার্থেলো পরীক্ষাগারে সর্বপ্রথম কার্বন ও হাইড্রোজেন থেকে মিথেন নামে জৈব যৌগটি প্রস্তুত করেন ।
উৎস : বদ্ধ জলাভূমিতে জৈব যৌগের (উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ) ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিয়োজনের ফলে মিথেন উৎপন্ন হয় । এই গ্যাসটি মার্শ গ্যাস নাম পরিচিত । ডোবা পুকুরের পাড়ে বসে থাকলে বুদবুদ আকারের মিথেন গ্যাস বেরোতে দেখতে পাওয়া যায় । প্রাকৃতিক গ্যাসে প্রচুর পরিমাণে মিথেন আছে, কয়লাখনিতে বিস্ফোরণের কারণই হল মিথেন । পেট্রোলিয়াম খনির প্রাকৃতিক গ্যাসে প্রায় 85% মিথেন থাকে । পরীক্ষাগারে শুষ্ক সোডিয়াম অ্যাসিটিটের সঙ্গে সোডালাইম মিশিয়ে উত্তপ্ত করলে মিথেন উৎপন্ন হয় । বিক্রিয়াটি হল : CH3COONa + NaOH = CH4↑ + Na2CO3 ।
[i] আলেয়া (Will-O-the-wisp) : বদ্ধ জলাভূমিতে উদ্ভিদ পদার্থের জৈব যৌগের ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিয়োজনের ফলে মিথেন উৎপন্ন হয়, আবার অনেক সময় প্রাণীদেহের বিয়োজনের ফলে ফসফিন (PH3), ডাই-ফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড (P2H4) জলাভূমিতে উৎপন্ন হয় । তাই জলাভূমিত যে মিথেন উৎপন্ন হয় তার সঙ্গে অনেক সময় ফসফিন ও ডাই-ফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড (P2H4) মিশে থাকে । (P2H4) বায়ুতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে ওঠে । ডাই-ফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড (P2H4) -এর বায়ুতে দহনের ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা মিথেনকে নীলাভ শিখায় জ্বলতে সাহায্য করে । ফলে বিচরণশীল আলোক শিখাই হল আলেয়া (Will-O-the wisp) । তাই বদ্ধ জলাভূমিতে বা শ্মশানে অনেক সময় আলেয়া দেখা যায় । আলেয়া কোনো ভৌতিক ঘটনা নয়, এটি একটি স্বভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা ।
[ii] মিথেনের প্রধান উৎস হল প্রাকৃতিক গ্যাস, যে গ্যাসে মিথেনের পরিমাণ প্রায় 45 — 96% । প্রাকৃতিক গ্যাস তেলের কূপ থেকে পাওয়া যায় ।
[iii] কয়লা খনিতে যে গ্যাস পাওয়া যায় তার মধ্যে মিথেন থাকে এবং খুবই দাহ্য যার ফলে কয়লা খনিতে বিস্ফোরণ ঘটে ।
[iv] কোল গ্যাসের মধ্যেও প্রায় 32—50% মিথেন থাক ।
মিথেনের ব্যবহার (Uses of Methane):
[i] মিথেনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয় । প্রতি মোল মিথেন গ্যাস পোড়ালে প্রায় 213 কিলো ক্যালোরি তাপ উৎপন্ন হয় ।
[ii] মিথেনের অসম্পূর্ণ দহনের ফলে কার্বন ব্ল্যাক পাওয়া যায় । এই কার্বন ব্ল্যাক পেন্টস ও ছাপার কালি প্রস্তুতে, জুতার কালি প্রস্তুতে, কার্বন-কাগজ, টাইপ রাইটারের ফিতায় এবং রাবার শিল্পে, মোটর গাড়ির চাকার জন্য ব্যবহৃত হয় ।
[iii] মিথেন থেকে অনেক রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- মিথাইল অ্যালকোহল, মিথাইল ক্লোরাইড, ক্লোরোফর্ম, মিথিলিন ক্লোরাইড, ফরম্যালডিহাইড, মিথানল, অ্যাসিটিলিন প্রভৃতি যৌগ প্রস্তুত করা হয় ।
[iv] মিথেনকে ব্যবহার করে শিল্প পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন গ্যাস প্রস্তুত করা হয় । অ্যামোনিয়ার সংশ্লেষণের জন্য এইভাবে হাইড্রোজেন পাওয়া যায় ।
তাপ উৎপাদন ছাড়াও মিথেনকে বর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদার্থের উৎস হিসাবে ব্যবহার করা হয় ।
রাসায়নিক ধর্ম (Chemical Properties of Methane) :
[ক] অক্সিজেনে দহন (Burning in oxygen) :- মিথেন অপরের দহনে সহায়তা করে না কিন্তু নিজে দাহ্য । বায়ুতে বা অক্সিজেনে মিথেন অদীপ্ত ফিকে নীলাভ শিখায় জ্বলে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জল উৎপন্ন করে ।
কয়লা খনির গ্যাসেও মিথেন থাকে । তাই কয়লাখনিতে মাঝে মাঝে বিস্ফোরণ ঘটে ।
মিথেনের দহনে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়, তাই মিথেনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ।
[খ] মিথেনের প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া (Substitution reaction of methane) :- অ্যালকেন মৌলগুলি সম্পৃক্ত মুক্ত শৃঙ্খল যৌগ । সম্পৃক্ত জৈব যৌগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতিস্থাপন বিক্রিয়াতে অংশ গ্রহণ করা । বিক্ষিপ্ত সূর্যালোকে ক্লোরিনের সঙ্গে মিথেনের প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া ঘটে । ক্লোরিন দ্বারা মিথেনের হাইড্রোজেন পরমাণু একটি একটি করে প্রতিস্থাপিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে মিথাইল ক্লোরাইড, মিথিলিন ক্লোরাইড, ক্লোরোফর্ম ও কার্বন টেট্রাক্লোরাইড উৎপন্ন করে । এখানে প্রথম ধাপটি দেখানো হল ।
মিথেন একটি গ্রিন হাউস গ্যাস (Mention that CH4 is a Greenhouse Gas) : ভূপৃষ্ঠে অনেক গ্যাসীয় পদার্থ আছে যারা সূর্য রশ্মিকে পৃথিবীতে আপতিত হতে বাধা দেয় না । কিন্তু উত্তপ্ত ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অবলোহিত বিকিরণকে মহাশূন্যে চলে যেতে বাধা দেয় । ওই দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকিরণকে ওই গ্যাসগুলি শোষণ করে ভুমন্ডলের উষ্ণতা বজায় রাখে । কিন্তু ওই গ্যাসগুলির পরিমাণ যদি বেড়ে যায়, তাহলে পরিমন্ডলের উষ্ণতাও বাড়তে থাকবে । সেই অতিরিক্ত অবলোহিত রশ্মি শোষক গ্যাসগুলির মধ্যে মিথেন অন্তর্ভুক্ত, তার ফলে পরিবেশে উষ্ণতাও ভীষণভাবে বেড়ে যাবে । এক কথায় গ্লোবাল ওয়ার্মিং (Global warming) ঘটে । তাই মিথেন গ্যাসটিকে গ্রিন হাউস গ্যাস বলে । গ্রিন হাউস এফেক্টে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরেই মিথেনের (CH4) স্থান । বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস এফেক্টে মিথেনের অবদান 15-20 শতাংশ । প্রতি অণু মিথেনের তাপ আটকে দেওয়ার ক্ষমতা CO2 এর ক্ষমতার তুলনায় 25 গুণ বেশি । পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ত্যক্ত মিথেনের মোট পরিমাণের 14% হল ভারতের অবদান ।
*****
- 8066 views