সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ (Nature of Women's Role in the Armed Revolution Struggles):-
বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ পরোক্ষভাবে অংশ নিতে শুরু করে । সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিধবা ভগিনী সরোজিনী দেবী বরিশালে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার করেন । যুগান্তর দলের যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের দিদি বিনোদিনী দেবী ও অনুশীলন সমিতির জীবনতারা হালদারের মা রাধারানি দেবী সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানান । বাঙালি বীরাঙ্গনারা কখনও বিপ্লবীদের গোপনে গৃহে আশ্রয় দিয়ে, কখনও গোপনে বিপ্লবীদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, কখনও বিপ্লবীদের অস্ত্র গোপনে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে, কখনও বা পুলিশকে বিভ্রান্ত করে বিপ্লবীদের পালাতে সাহায্য করে পরোক্ষভাবে বৈপ্লবিক কাজে অংশ গ্রহণ করেন । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সমাজের উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত পরিবারগুলির নারীরা একযোগে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন । প্রথমদিকে নারীরা প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী কাজে যোগ না দিয়ে তারা বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়ে, অস্ত্র সরবরাহ করে, গোপন স্থানে সংবাদ পৌঁছে দিয়ে, পুলিশকে বিভ্রান্ত করে বিপ্লবীদের পালাতে সাহায্য করে পরোক্ষভাবে বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন । বিপ্লবীরা যখন দেশমাতার মুক্তির জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে চলেছেন তখন বহু নারী নিজেদের টাকা-পয়সা, সোনার গহনা প্রভৃতি দিয়ে পরোক্ষভাবে বৈপ্লবিক আন্দোলনে সহায়তা করেন । পরবর্তীকালে নারীরা সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সশস্ত্র বিপ্লবে বাঙালি নারীরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন । ব্রিটিশ সরকার পুলিশি অত্যাচার, গ্রেপ্তার, নির্বাসন প্রভৃতি নির্যাতন চালাতে থাকলেও নারীদের আন্দোলন থেমে থাকে নি । হাওড়া জেলার বালির সূর্যকান্ত ব্যানার্জীর বিধবা কন্যা ননীবালা দেবী ভারত-জার্মান বিপ্লবী ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন । তিনি পালাতে গিয়ে সুদুর পেশোয়ারে ধরা পড়েন । ভারত-জার্মান বিপ্লবী ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে সিন্ধুবালা দেবীকে গ্রেপ্তার করা হয় । বিপ্লবীরা রডা কোম্পানির পিস্তল লুঠ করেন । বিপ্লবীদের লুঠ করা পিস্তলগুলি সংরক্ষণের অপরাধে বীরভূমের নলহাটির দুকড়িবালা দেবী, ঢাকার বগলাসুন্দরী দেবী ও বিন্দুবাসিনী দেবী এবং বরিশালের দুর্গামণি পাইন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ও পিস্তল সংরক্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন । সশস্ত্র বিপ্লবী নারীদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস এবং কল্পনা দত্ত প্রমুখ মহিলা বিপ্লবীদের আত্মবলিদান ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে । ভগিনী নিবেদিতা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত থেকে বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেন । তিনি বাংলার গুপ্ত সমিতি, অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ।
বাংলার নারীরা ব্রিটিশ-বিরোধী বৈপ্লবিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু-ভবেই অংশ গ্রহণ করেছেন । প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন নারী বৈপ্লবিক কার্যকলাপে যেরকম দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ।
*****