লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 01/05/2021 - 11:06

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Expression of Nationalism in Literary Works and Paintings):-

ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা শুরু হয় ও ক্রমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে । সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল । নিজেদের স্বার্থে ভারতকে শোষণ করাই ছিল ইংরেজদের উদ্দেশ্য । ফলে ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সঞ্চার অনিবার্য ছিল । অবশ্য তাদের প্রত্যেকের ক্ষোভ একই রকম ছিল না । কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির ক্ষোভ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভ, জমিদারের ও পুঁজিপতি শ্রেণির ক্ষোভ, মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষোভ — প্রতিটি শ্রেণিভুক্ত মানুষদের ক্ষোভ ছিল ভিন্ন রকমের । কোনো শ্রেণির ক্ষোভের অন্য কোনো শ্রেণির ক্ষোভের কোনো মিল ছিল না । জাতীয়তাবোধের উন্মেষে শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভের ভূমিকা ছিল সব থেকে বেশি এবং পুঞ্জিভুত এই ক্ষোভ থেকেই শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে । এই শ্রেণির মানুষরাই চেয়েছিল মাতৃভূমির শাসনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও পরিশেষে স্বাধীনতা । সুচতুর ব্রিটিশ শাসকরাও এই বিষয়ে অবহিত ছিল । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতীয় জনগণকে কিছুটা খুশি করার জন্য শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের কিছুটা সুযোগ দেয় । ব্রিটিশদের এই প্রচেষ্টার মধ্যে কোনো আন্তরিকতা না থাকায় ভারতীয় জনগণ তাতে খুশি হয়নি । শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা বাদামি বর্ণের ভারতীয়দের মানুষ বলেই মনে করত না ও ভারতীয়দের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার কোনো সদিচ্ছা ব্রিটিশদের ছিল না ।

শুধুমাত্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ থাকলেই জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে না, তার সঙ্গে দরকার স্বচ্ছদৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক প্রস্তুতি ও চেতনাবোধ । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ছিল । পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পশ্চিমের ইতিহাস থেকে জাতীয়তাবোধের পাঠ গ্রহণ করে । আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন প্রভৃতি ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের বিকাশে অনুপ্রাণিত করেছিল । ভারতীয় সাহিত্যও তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের সঞ্চারে সহায়ক হয়েছিল । বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি সাহিত্যিক, অহমিয়া ভাষায় লক্ষীকান্ত বেজবড়ুয়া, মারাঠি ভাষায় বিষ্ণুশাস্ত্রী চিপলংকার, তামিলে সুব্রমণ্য ভারতী, হিন্দিতে ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র এবং উর্দুতে আলতাফ হোসেন আলি প্রমুখের রচনা দেশপ্রেমের সঞ্চার ঘটায় । এই সমস্ত সাহিত্যের সঙ্গে সংবাদপত্রও জাতীয়তাবোধের বিকাশে সহায়ক হয়েছিল । এই সমস্ত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে হিন্দু প্যাট্রিয়ট, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়া মিরর, সোমপ্রকাশ, বেঙ্গলি, মারহাট্টা, কেশরী, হিন্দু প্রভৃতি বিশেভাবে উল্লেখযোগ্য । সীমিত সুযোগ সত্ত্বেও চিত্রশিল্পীরাও তাদের আঁকা ছবির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের বিকাশে সহায়ক হয়েছিল । এই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ছোটো ভাই গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান বিশেষেভাবে উল্লেখযোগ্য ।

*****

Comments

Related Items

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society)

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society):-

বাঙালিদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণা কর

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Participation of Students in the anti-Partition Movement of Bengal):-

বাংলার মানুষদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্র

বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Students' Movements in Twentieth Century):-

বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দ

আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী

আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী (Women's Wing of the Ajad Hind Fauj):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাসবিহারী বসু জাপানে গিয়ে সেখানে তিনি বিপ্লবীদের সংগঠিত করার চেষ্টায় ছিলেন । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের

কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta)

কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta):-

বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ প্রথমদিকে পরোক্ষভাবে অংশ নিতে শুরু করলেও ব