মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ)

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 01/01/2021 - 17:30

মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ) (Queen's Proclamation) : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় । এই যুদ্ধের একশো বছর পর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ বা সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয় । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডে প্রথম ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং ক্রমে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ব্যক্তির নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে । এই বিদ্রোহে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সিপাহিরা ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষের অনেকেই অংশ গ্রহণ করে । ঔপনিবেশিক অর্থনীতি, শাসন ও শোষণ রাজা, প্রজা প্রভৃতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ বিরোধী করে তোলে । পরিণতিতে ভারতের নানা অঞ্চলের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন । আঞ্চলিক সীমার গণ্ডি অতিক্রম করে ক্ষোভের এই বহিঃপ্রকাশ অনেকাংশে সর্বভারতীয় রূপ নেয় । সিপাহি ও জনগণের মিলিত এই বিদ্রোহের দাপটে ব্রিটিশ প্রশাসন ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে । রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই -এর চেয়ে গণশক্তির মিলিত প্রতিবাদ দমন করা যে অনেক কঠিন কাজ তা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে ব্রিটিশরা উপলব্ধি করে । মহাবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও মহাবিদ্রোহের তীব্রতায় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয় । সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার উপলবদ্ধি করে যে, ভারতের মতো একটা সুবিশাল ও সমৃদ্ধশালী দেশের শাসনভার ব্রিটিশ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে রাখা আর নিরাপদ নয় । এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 'ভারত শাসন আইন' পাস করিয়ে ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটায় এবং মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন ।

মহারানি ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর এক ঘোষণাপত্রর মাধ্যমে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন নীতি ও আদর্শের কথা ঘোষণা করেন । এই ঘোষণাপত্রটি 'মহারানির ঘোষণাপত্র' নামে পরিচিত । মহারানির নির্দেশে তাঁর প্রধানমন্ত্রী ডারবি এই ঘোষণাপত্রটি রচনা করেন । ঘোষণাপত্রটি রচনা সময় মহারানি ডারবিকে নির্দেশ দেন যে, ঘোষণাপত্রটির মধ্যে ভারতবাসী যেন তার উচ্চ আদর্শ, সহৃদয়তা, সুশাসন, আন্তরিকতা ও ধর্মীয়ভাবের প্রতিফলন দেখতে পায় । ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, এইসময় থেকে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট থেকে নির্বাচিত সদস্যরা ব্রিটিশ উপনিবেশে ভারতশাসন করবে । মহারানির প্রতিনিধি হিসেবে নতুন গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় ক্যানিং এলাহাবাদে দরবার করে এই ঘোষণাপত্রটি প্রচার করেন ।

মহারানির ঘোষণাপত্রের দ্বারা জানানো হয়—

(১) এখন থেকে ভারতের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে মহারানি নিজের হাতে নিলেন ।

(২) ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সন্ধিগুলি মেনে চলবে ।

(৩) দেশীয় রাজাদের অধিকার, সম্মান, মর্যাদা এবং রাজ্যসীমা এখন থেকে অক্ষুণ্ন থাকবে ।

(৪) স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হবে এবং দেশীয় রাজাদের দত্তক গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে ।

(৫) দেশীয় রাজাদের রাজ্যে মহারানির সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না ।

(৬) ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না ।

(৭) জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি যোগ্য ভারতীয়কে সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার প্রদান করা হবে ।

(৮) ব্রিটিশরা ভারতে আর সাম্রাজ্য বিস্তার করবে না ।

বলাবাহুল্য মহারানির ঘোষণাপত্রে ভারতীয়দের বহু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সেগুলি বাস্তবে রূপায়িত হয়নি, সেগুলি ঘোষণাপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । তাই ভারতীয়দের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি । ক্রমশ ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর ক্ষোভ, হতাশা, ঘৃণা বাড়তেই থাকে । এই ক্ষোভ থেকে বাংলা তথা ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা শুরু হয় । 

*****

Comments

Related Items

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society)

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society):-

বাঙালিদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণা কর

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Participation of Students in the anti-Partition Movement of Bengal):-

বাংলার মানুষদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্র

বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Students' Movements in Twentieth Century):-

বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দ

আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী

আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী (Women's Wing of the Ajad Hind Fauj):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাসবিহারী বসু জাপানে গিয়ে সেখানে তিনি বিপ্লবীদের সংগঠিত করার চেষ্টায় ছিলেন । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের

কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta)

কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta):-

বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ প্রথমদিকে পরোক্ষভাবে অংশ নিতে শুরু করলেও ব