Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 02/12/2021 - 17:11

কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta):-

বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ প্রথমদিকে পরোক্ষভাবে অংশ নিতে শুরু করলেও বিশ শতকে ১৯৩০ এর দশক থেকে নারীরা সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন । ব্রিটিশ সরকার পুলিশি অত্যাচার, গ্রেপ্তার, নির্বাসন প্রভৃতি নির্যাতন চালাতে থাকলেও নারীদের আন্দোলন থেমে থাকে নি । বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার যেসব নারী ব্রিটিশ-বিরোধী সসস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ছিলেন অন্যতম ।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই ব্রিটিশ ভারতের বর্তমানে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুরে কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহণ করেন । রায়বাহাদুর পরিবারের সদস্যা ছিলেন কল্পনারানি দত্তগুপ্ত, যিনি কল্পনা দত্ত নামে পরিচিত হন । পিতা বিনোদবিহারী দত্তগুপ্ত ছিলেন সরকারী কর্মী, মাতা শোভনাবালা ও ঠাকুরদা ছিলেন দুর্গাদাস দত্তগুপ্ত । চট্টগ্রাম থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর কল্পনা দত্ত কলকাতায় বেথুন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন । বেথুন কলেজে পড়াশুনার সময় তিনি নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সংস্পর্শে আসেন । শহীদ ক্ষুদিরাম এবং বিপ্লবী কানাই লাল দত্তের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বেথুন কলেজে গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘে যোগদান করেন । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামে ফিরে এসে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে বিপ্লবী সূর্য সেনের সঙ্গে পরিচিত হন ও মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহকর্মী হিসেবে বিপ্লবের কাজে যোগদান করেন । তিনি প্রথমদিকে যুগান্তর দলের সদস্যা ছিলেন । মাস্টারদা সূর্য সেনের সহকর্মী হিসেবে তিনি বেশকিছু বিপ্লবী পরিকল্পনা রচনার সাক্ষী ছিলেন । মাস্টারদা সূর্যসেনের নির্দেশমতো কল্পনা দত্ত ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রামের জেলখানা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । যদিও শেষপর্যন্ত জেলখানা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা কার্যকর করা যায় নি । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মাস্টারদা সূর্য সেন পরিকল্পিত চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্বভার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর ন্যাস্ত করলে কল্পনা দত্ত ঐ দলের সহযোগী হন । কিন্তু ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে পুরূষের ছদ্মবেশে একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ও গ্রেফতার হন । জেলে বসে তিনি অপারেশন পাহাড়তলী এবং বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মহত্যার খবর শোনেন ।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কল্পনা দত্ত ও তাঁর কয়েকজন সঙ্গী চট্টগ্রামের গৈরালা গ্রামে ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন । সংঘর্ষের পর ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাদের গোপন ডেরা ঘিরে ফেললে কল্পনা দত্ত পালাতে সক্ষম হলেও মাস্টারদা সূর্য সেন পুলিশের হাতে বন্দী হন । কিছুদিন পর কল্পনা দত্ত এবং তার কিছু সহযোদ্ধা গৈরালা গ্রামে পুলিশের সঙ্গে অন্য একটি সংঘর্ষে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন । বিচারে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় মাস্টারদা সূর্য সেনকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করা হয় ও কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় । মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসির পর তাঁর বন্দিজীবন কাটে মেদিনীপুর জেলে । পড়াশোনায় মেধাবী হয়েও তিনি স্বেচ্ছায় বিপ্লবী জীবন বেছে নিয়েছিলেন । তাঁর বিপ্লবী জীবনের আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে বাঙালি নারীদের স্বদেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করে ।

১৯৩৯ সালে মুক্তি লাভের পর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যান । ১৯৯৫ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি নয়া দিল্লীতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ।

****

Comments

Related Items

রেগুলেটিং আইন, পিটস আইন ও সনদ আইন

দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের কয়েক বছর পর ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস হয়েছিল । কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে নেওয়ার এটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ । কোম্পানির নায়েব-দেওয়ান ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বল্গাহীন ও অবাধ ...

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে শক্তির ভারসাম্য ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে সরে গিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার অনুকূলে চলে যায় । দুটি বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের আবির্ভাবে দুটি নতুন শক্তিজোট তৈরি হয়, যার এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দিকে সোভিয়েত ...

বেলগ্রেড সম্মেলন (Conference in Belgrade, 1961)

১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ৬ই সেপ্টেম্বর যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির 'বেলগ্রেড সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয় । আফগানিস্তান, আলজিরিয়া, কিউবা, সাইপ্রাস, ইথিওপিয়া, ঘানা, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, ব্রহ্মদেশ, কাম্বোডিয়া, সিংহল, কঙ্গো ...

পঞ্চশীল নীতি (Panchsheel Treaty)

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের পঞ্চশীল নীতি হল ভারত উদ্ভাবিত একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া । ভারতের জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি পঞ্চশীলের উপর স্থাপিত । পঞ্চশীল বলতে এখানে বলা হয়েছে-প্রতিটি স্বাধীন দেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল হওয়া ...

বান্দুং সম্মেলন (Bandung Conference)

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ থেকে ২৪শে এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে ‘বান্দুং সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় । জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পক্ষে এই ‘বান্দুং সম্মেলন’ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । এই সম্মেলনে এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশের প্রতিনিধিরা মিলিতভাবে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ...