আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 02/13/2021 - 10:17

আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী (Women's Wing of the Ajad Hind Fauj):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাসবিহারী বসু জাপানে গিয়ে সেখানে তিনি বিপ্লবীদের সংগঠিত করার চেষ্টায় ছিলেন । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে টোকিওয় এবং জুন মাসে রাসবিহারী বসু ব্যাংককে দুটি সম্মেলনের আয়োজন করেন । সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ (Indian Independence League) স্থাপিত হয় ও ভারতের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি জাতীয় মুক্তিফৌজ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয় এবং জাপানের হাতে পরাজিত ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১ লা সেপ্টেম্বর রাসবিহারী বসুর প্রচেষ্টায় আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠিত হয় । ব্যাঙ্কক সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপানে আসার আমন্ত্রণ জানানো হলে প্রতিকূল অবস্থা এবং বিপদের সর্বপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু এক দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রায় ডুবো জাহাজে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জুন টোকিওতে উপনীত হন । টোকিওয় জাপানি প্রধানমন্ত্রী তোজো ও অন্যান্য সরকারি প্রতিনিধিবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের মুক্তি সংগ্রামে সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে এলে রাসবিহারী বসু তাঁকে সাদরে বরণ করে নিয়ে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর হাতে ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করেন ।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের সাহায্যে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনাকালে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জুলাই ভারতের একটি নারী বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা নেন এবং তদনুযায়ী ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট গড়ে তোলেন । সিঙ্গাপুরের হিন্দু, মুসলমান, শিখ সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০০ স্বেচ্ছাসেবিকা এই নারী বাহিনীতে যোগ দেন । নারী  বাহিনীর সদস্যাদের মেশিনগান ও টমিগান চালানো, হাতবোমা ছোড়া, রাইফেল চালানো প্রভৃতির প্রশিক্ষণ নিতে হয় ও ছয় মাস কঠোর সামরিক শিক্ষাগ্রহণ করতে হয় । সামরিক শিক্ষা গ্রহণের শেষে প্রায় আধমণ ওজনের ভারী রাইফেল আর গুলি বারুদের বোঝা নিয়ে নারী বাহিনীর সদস্যাদের সপ্তাহে দুই দিন ১৫-২০ কুড়ি মাইল হাঁটতে হত । এই বাহিনীর একশ্রেণির কাজ ছিল যুদ্ধ করা ও অপর শ্রেণির কাজ ছিল যুদ্ধে আহতদের সেবাশুশ্রূষা করা । ক্রমে এই বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবীকার সংখ্যা প্রায় কয়েক হাজার হয়ে বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে ।

অক্ষশক্তিভুক্ত জাপান ভারতের মাটিতে মিত্রশক্তিভুক্ত ব্রিটিশ শক্তিকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলে আজাদ হিন্দ বাহিনী ও ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ঝাঁসি বাহিনী সিঙ্গাপুর থেকে ব্রহ্মদেশের দিকে এগোতে থাকে । কিন্তু হঠাৎ বিশ্বযুদ্ধের গতি পরিবর্তন এবং মিত্রশক্তিভুক্ত বাহিনীর হাতে জাপানের পরাজয়ে জাপান সরকার সাহায্যদান বন্ধ করে দিলে আজাদ হিন্দ বাহিনীতেও বিপর্যয় ঘনিয়ে আসে । শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ বাহিনী পরাজিত হয় ও ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন ব্রিটিশ সেনার হাতে গ্রেফতার হন । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত তিনি বার্মার জেলে বন্দি ছিলেন ।

বিদেশের মাটি থেকে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী যে অবদান রেখেছিল তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতীয় নারীসমাজকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে । 

*****

Comments

Related Items

ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পটভূমি - তৃতীয় পর্যায়

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ভারতে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে আসছিলেন । এতে ইন্ধন যোগান ঊর্দু কবি মহম্মদ ইকবাল ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলি । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ইকবাল 'অখন্ড ইসলাম তত্ত্ব' ...

ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পটভূমি - দ্বিতীয় পর্যায়

ইতিমধ্যে মহম্মদ আলি জিন্না ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করলে একটি নতুন যুগের সুচনা হয় । মহম্মদ আলি জিন্না প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । পরে তিনি কংগ্রেসকে মুসলিমদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে বলেন । মহম্মদ আলি জিন্না ও বালগঙ্গাধর তিলকের ..

আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই জুলাই ভারতের বিশিষ্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ইচ্ছা অনুসারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন । নেতাজির রণধ্বনি ‘দিল্লী চলো’ ও ‘জয় হিন্দ’ মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারত সীমান্তে এসে পৌঁছায় । ...

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব

১৯৪২ সালের ৯ই আগষ্ট এর ভোর থেকেই ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু হয়, প্রথম পর্যায়ে এই আন্দোলন কলকাতা, বোম্বাই, দিল্লী, নাগপুর, আমেদাবাদ, বরোদা, ঢাকা প্রভৃতি শহরে ছড়িয়ে পড়ে । মিছিল, মিটিং, পিকেটিং ও হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে ছাত্র, যুবক, মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক ...

বাংলার বাইরে বিপ্লবী আন্দোলন

বাংলা দেশের বাইরে বিহার, যুক্তপ্রদেশ, রাজস্থান, বোম্বাই এবং মাদ্রাজে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী কার্যকলাপ পরিচালিত হয়েছিল । বাংলার বাইরে সন্ত্রাসবাদীদের যে সকল সংস্থা গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশে গঠিত 'হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন' সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য । ...