বহুরূপী
সুবোধ ঘোষ
হরিদার কাছে আমরাই গল্প করে বললাম, শুনেছেন, হরিদা কী কাণ্ড হয়েছে ?
উনানের মুখে ফুঁ দিয়ে আর অনেক ধোঁয়া উড়িয়ে নিয়ে হরিদা এইবার আমাদের কথার জবাব দিলেন — না, কিছুই শুনিনি ।
— জগদীশবাবু যে কী কাণ্ড করেছেন, শোনেননি হরিদা ?
হরিদা — না রে ভাই, বড়ো মানুষের কাণ্ডের খবর আমি কেমন করে শুনব ? আমাকে বলবেই বা কে ?
— সাতদিন হলো এক সন্ন্যাসী এসে জগদীশবাবুর বাড়িতে ছিলেন । খুব উঁচু দরের সন্ন্যাসী । হিমালয়ের গুহাতে থাকেন । সারা বছরে শুধু একটি হরীতকী খান; এ ছাড়া আর কিছুই খান না । সন্ন্যাসীর বয়সও হাজার বছরের বেশি বলে অনেকেই মনে করেন ।
হরিদা — সন্ন্যাসী কি এখনও আছেন ?
— না, চলে গিয়েছেন ।
আক্ষেপ করেন হরিদা — থাকলে একবার গিয়ে পায়ের ধুলো নিতাম ।
— তা পেতেন না হরিদা ! সে ভয়ানক দুর্লভ জিনিস । শুধু ওই একা জগদীশবাবু ছাড়া আর কাউকে পায়ের ধুলো নিতে দেননি সন্ন্যাসী ।
হরিদা — কেন ?
— জগদীশবাবু একজোড়া কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ধরলেন । তখন বাধ্য হয়ে সন্ন্যাসী পা এগিয়ে দিলেন, নতুন খড়ম পরলেন আর সেই ফাঁকে জগদীশবাবু পায়ের ধুলো নিয়েছিলেন ।
হরিদা — বাঃ, এ তো বেশ মজার ব্যাপার !
হ্যাঁ, তা ছাড়া সন্ন্যাসীকে বিদায় দেবার সময় জগদীশবাবু একশো টাকার একটা নোট জোর করে সন্ন্যাসীর ঝোলার ভেতরে ফেলে দিলেন । সন্ন্যাসী হাসলেন আর চলে গেলেন ।
গল্প শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন হরিদা । অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন । আমরা কী বলছি বা না বলছি, সেদিকে হরিদার যেন কান নেই ।
হরিদার উনানের আগুন তখন বেশ গনগনে হয়ে জ্বলছে । আমাদের চায়ের জন্য এক হাঁড়ি ফুটন্ত জল নামিয়ে দিয়েই হরিদা তাঁর ভাতের হাঁড়িটাকে উনানে চড়ালেন ।
শহরের সবচেয়ে সরু এই গলিটার ভিতরে এই ছোট্ট ঘরটাই হরিদার জীবনের ঘর; আর আমাদের চারজনের সকাল-সন্ধ্যার আড্ডার ঘর । চা চিনি আর দুধ আমরাই নিয়ে আসি । হরিদা শুধু তাঁর উনানের আগুনের আঁচে জল ফুটিয়ে দেন ।
খুবই গরিব মানুষ হরিদা । কিন্তু কাজ করতে হরিদার প্রাণের মধ্যেই যেন একটা বাধা আছে । ইচ্ছে করলে কোনো অফিসের কাজ, কিংবা কোনো দোকানের বিক্রিওয়ালার কাজ পেয়ে যেতে পারেন হরিদা; কিন্তু ওই ধরনের কাজ হরিদার জীবনের পছন্দই নয় । একেবারে ঘড়ির কাঁটার সামনে সময় বেঁধে দিয়ে আর নিয়ম করে নিয়ে রোজই একটা চাকরির কাজ করে যাওয়া হরিদার পক্ষে সম্ভব নয় । হরিদার উনানের হাঁড়িতে অনেক সময় শুধু জল ফোটে, ভাত ফোটে না । এই একঘেয়ে অভাবটাকে সহ্য করতে হরিদার আপত্তি নেই, কিন্তু একঘেয়ে কাজ করতে ভয়ানক আপত্তি ।
হরিদার জীবনে সত্যিই একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য আছে । আর, সেটাই যে হরিদার জীবনের পেশা । হরিদা মাঝে মাঝে বহুরূপী সেজে যেটুকু রোজকার করেন, তাতেই তাঁর ভাতের হাঁড়ির দাবি মিটিয়ে দিতে চেষ্টা করেন । মাঝে মাঝে সত্যিই উপোস করেন হরিদা । তারপর একদিন হঠাৎ আবার এক সকালে কিংবা সন্ধ্যায় বিচিত্র ছদ্মবেশে অপরূপ হয়ে পথে বের হয়ে পড়েন । কেউ চিনতে পারে না । যারা চিনতে পারে এক-আনা দু-আনা বকশিশ দেয় । যারা চিনতে পারে না, তারা হয় কিছুই দেয় না, কিংবা বিরক্ত হয়ে দুটো-একটা পয়সা দিয়ে দেয় ।
একদিন চকের বাস স্ট্যান্ডের কাছে ঠিক দুপুরবেলাতে একটা আতঙ্কের হল্লা বেজে উঠেছিল । একটা উন্মাদ পাগল; তার মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ছে, চোখ দুটো কটকটে লাল । তার কোমরে একটা ছেঁড়া কম্বল জড়ানো, গলায় টিনের কৌটার একটা মালা । পাগলটা একটা থান ইট হাতে তুলে নিয়ে বাসের উপরে বসা যাত্রীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে । চেঁচিয়ে উঠছে যাত্রীরা, দুটো একটা পয়সা ফেলেও দিচ্ছে ।
একটু পরেই বাসের ড্রাইভার কাশীনাথ ধমক দেয় । — খুব হয়েছে হরি, এই বার সরে পড়ো । অন্যদিকে যাও ।
অ্যাঁ ? ওটা কি একটা বহুরূপী ? বাসের যাত্রীরা কেউ হাসে, কেউ বা বেশ বিরক্ত হয় কেউ আবার বেশ বিস্মিত । সত্যিই, খুব চমৎকার পাগল সাজতে পেরেছে তো লোকটা ।
হরিদার জীবন এইরকম বহু রূপের খেলা দেখিয়েই একরকম চলে যাচ্ছে । এই শহরের জীবনে মাঝে মাঝে বেশ চমৎকার ঘটনা সৃষ্টি করেন বহুরূপী হরিদা । সন্ধ্যার আলো সবেমাত্র জ্বলেছে, দোকানে দোকানে লোকজনের ব্যস্ততা আর মুখরতাও জমে উঠেছে । হঠাৎ পথের উপর দিয়ে ঘুঙুরের মিষ্টি শব্দ রুমঝুম করে বেজে-বেজে চলে যেতে থাকে । এক রূপসি বাইজি প্রায় নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে । শহরে যারা নতুন এসেছে, তারা দুই চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকে । কিন্তু দোকানদার হেসে ফেলে — হরির কাণ্ড ।
অ্যাঁ ? এটা একটা বহুরূপী নাকি ? কারও কারও মুগ্ধ চোখের মোহভঙ্গ হয়, আর যেন বেশ একটু হতাশস্বরে প্রশ্ন করে ওঠে ।
বাইজির ছদ্মবেশে সেদিন হরিদার রোজগার মন্দ হয়নি । মোট আট টাকা দশ আনা পেয়েছিলেন । আমরাও দেখেছিলাম, এক-একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই রূপসি বাইজি, মুচকি হেসে আর চোখ টিপে একটা ফুলসাজি এগিয়ে দিচ্ছে । দোকানদারও হেসে ফেলে আর একটা সিকি তুলে নিয়ে বাইজির হাতের ফুলসাজির উপর ফেলে দেয় ।
কোনদিন বাউল, কোনদিন কাপালিক । কখনও বোঁচকা কাঁধে বুড়ো কাবুলিওয়ালা, কখনও হ্যাট-কোট-প্যান্টালুন-পরা ফিরিঙ্গি কেরামিন সাহেব । একবার পুলিশ সেজে দয়ালবাবুর লিচু বাগানের ভিতরে দাঁড়িয়েছিলেন হরিদা; স্কুলের চারটে ছেলেকে ধরেছিলেন । ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল ছেলেগুলো; আর স্কুলের মাস্টার এসে সেই নকল পুলিশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন — এবারের মতো মাপ করে দিন ওদের । কিন্তু আটআনা ঘুষ নিয়ে তারপর মাস্টারের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন সেই-নকল হরিদা ।
পরদিন অবশ্য স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের জানতে বাকি থাকেনি, কাকে তিনি আটআনা ঘুষ দিয়েছেন । কিন্তু মাস্টারমশাই একটুও রাগ করেননি । বরং একটু তারিফই করলেন — বা, সত্যি, খুব চমৎকার পুলিশ সেজেছিল হরি !
আজ এখন কিন্তু আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, হরিদা এত গম্ভীর হয়ে কী ভাবছেন । সন্ন্যাসীর গল্পটা শুনে কি হরিদার মাথার মধ্যে নতুন কোনো মতলব ছটফট করে উঠেছে ?
ঠিকই, আমাদের সন্দেহ মিথ্যে নয় । হরিদা বললেন — আজ তোমাদের একটা জবর খেলা দেখাব ।
— আমাদের দেখিয়ে আপনার লাভ কি হরিদা ? আমাদের কাছ থেকে একটা সিগারেটের চেয়ে বেশি কিছু তো পাবেন না ।
হরিদা — না, ঠিক তোমাদের দেখাব না । আমি বলছি তোমরা সেখানে থেকো । তাহলে দেখতে পাবে ...।
— কোথায় ?
হরিদা — আজ সন্ধ্যায় জগদীশবাবুর বাড়িতে ।
— হঠাৎ জগদীশবাবুর বাড়িতে খেলা দেখাবার জন্যে আপনার এত উৎসাহ জেগে উঠল কেন ?
হরিদা হাসেন — মোটা মতন কিছু আদায় করে নেব । বুঝতেই তো পারছ, পুরো দিনটা রূপ ধরে ঘুরে বেরিয়েও দু-তিন টাকার বেশি হয় না । একবার বাইজি সেজে অবিশ্যি কিছু বেশি পাওয়া গিয়েছিল । কিন্তু ওতেই বা কি হবে ?
ঠিকই বলেছেন হরিদা । সপ্তাহে বড়োজোর একটা দিন বহুরূপী সেজে পথে বের হন হরিদা । কিন্তু তাতে সাতদিনের পেট চলবার মতো রোজগার হয় না ।
হরিদা বলেন — নাঃ, এবার আর কাঙালের মতো হাত পেতে বকশিশ নেওয়া নয় । এবার মারি তো হাতি, লুঠি তো ভাণ্ডার । একেবারেই যা ঝেলে নেব তাতে আমার সারা বছর চলে যাবে ।
কিন্তু সে কী করে সম্ভব ? জগদীশবাবু ধনী মানুষ বটেন, কিন্তু বেশ কৃপণ মানুষ । হরিদাকে একটা যোগী সন্ন্যাসী কিংবা বৈরাগী সাজতে দেখে কত আর খুশি হবেন জগদীশবাবু ? আর খুশি হলেই বা কত আনা বকশিশ দেবেন । পাঁচ আনার বেশি তো নয় ।
হরিদা বলেন — তোমরা যদি দেখতে চাও, তবে আজ ঠিক সন্ধ্যাতে জগদীশবাবুর বাড়িতে থেকো ।
আমরা বললাম — থাকব; আমাদের স্পোর্টের চাঁদা নেওয়ার জন্য আজ ঠিক সন্ধ্যাতেই জগদীশবাবুর কাছে যাব !
২
বড়ো চমৎকার আজকে এই সন্ধ্যার চেহারা । আমাদের শহরের গায়ে কতদিন তো চাঁদের আলো পড়েছে, কিন্তু কোনোদিন তো আজকের মতো এমন একটা স্নিগ্ধ ও শান্ত উজ্জ্বলতা কখনও চারিদিকে এমন সুন্দর হয়ে ফুটে ওটেনি ।
ফুরফুর করে বাতাস বইছে । জগদীশবাবুর বাড়ির বাগানের সব গাছের পাতাও ঝিরিঝিরি শব্দ করে কী যেন বলতে চাইছে । জগদীশবাবুর বাড়ির বারান্দাতে মস্ত বড়ো একটা আলো জ্বলছে । সেই আলোর কাছে একটা চেয়ারের উপর বসে আছেন জগদীশবাবু । সাদা মাথা, সাদা দাড়ি, সৌম্য শান্ত ও জ্ঞানী মানুষ জগদীশবাবু । আমরা আমাদের স্পোর্টের চাঁদার খাতাটিকে জগদীশবাবুর হাতে তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ।
চমকে উঠলেন জগদীশবাবু । বারান্দার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে জগদীশবাবুর দুই বিস্মিত চোখ অপলক হয়ে গেল ।
আমরা চমকে উঠেছি বইকি । আশ্চর্য হয়েছি, একটু ভয়ও পেয়েছি । কারণ, সত্যিই যে বিশ্বাস করতে পারছি না, সিঁড়ির কাছে এসে যে দাঁড়িয়েছে, সে কি সত্যিই হরিদা ? ও চেহারা কি সত্যিই কোনো বহুরূপীর হতে পারে ?
জটাজুটধারী কোনো সন্ন্যাসী নয় । হাতে কমণ্ডলু নেই, চিমটে নেই । মৃগচর্মের আসনও সঙ্গে নেই । গৈরিক সাজও নেই ।
আদুড় গা, তার উপর একটা ধবধবে সাদা উত্তরীয় । পরনে ছোটো বহরের একটি সাদা থান ।
মাথায় ফুরফুর করে উড়ছে শুকনো সাদা চুল । ধুলো মাখা পা, হাতে একটা ঝোলা, সে ঝোলার ভিতরে শুধু একটা বই, গীতা । গীতা বের করে কী-যেন দেখলেন এই আগন্তুক । তারপর নিজের মনেই হাসলেন ।
আগন্তুক এই মানুষটি যেন এই জগতের সীমার ওপার থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছেন । শীর্ণ শরীরটাকে প্রায় অশরীরী একটা চেহারা বলে মনে হয় । কী অদ্ভুত উদাত্ত শান্ত ও উজ্জ্বল একটা দৃষ্টি এই আগন্তুকের চোখ থেকে ঝরে পড়েছে ।
উঠে দাঁড়ালেন জগদীশবাবু — আসুন ।
আগন্তুক হাসেন — আপনি কি ভগবানের চেয়েও বড়ো ?
জগদীশবাবু কিছু ভেবে বলেন — কেন ? কেন আপনি একথা কেন বলছেন মহারাজ ?
আমি মহারাজ নই, আমি এই সৃষ্টির মধ্যে এককণা ধুলি । — কিন্তু আপনি বোধহয় এগারো লক্ষ টাকার সম্পত্তির অহংকারে নিজেকে ভগবানের চেয়েও বড়ো বলে মনে করেন । তাই ওখানেই দাঁড়িয়ে আছেন, নেমে আসতে পারছেন না ।
সেই মুহূর্তে সিঁড়ি ধরে নেমে যান জগদীশবাবু । — আমার অপরাধ হয়েছে । আপনি রাগ করবেন না ।
আগন্তুক আবার হাসেন — আমি বিরাগী, রাগ নামে কোনো রিপু আমার নেই । ছিল একদিন, সেটা পূর্বজন্মের কথা ।
জগদীশবাবু — বলুন, এখন আপনাকে কীভাবে সেবা করব ?
বিরাগী বলেন — ঠান্ডা জল চাই, আর কিছু চাই না ।
ঠান্ডা জল খেয়ে নিয়ে হাঁপ ছাড়েন বিরাগী । এদিকে ভবতোষ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে । — না না, হরিদা নয় । হতেই পারে না । অসম্ভব ! হরিদার গলার স্বর এরকমেরই নয় ।
বিরাগী বলেন — পরম সুখ কাকে বলে জানেন ? সব সুখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া !
ভবতোষের কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে অনাদি বলে— শুনছো তো ? এসব ভাষা কি হরিদার মুখের ভাষা হতে পারে ?
জগদীশবাবু ততক্ষণে সিঁড়ির উপরে বসে পড়েছেন । বোধহয় বিরাগীর পা স্পর্শ করবার জন্যে তাঁর হাত দুটো ছটফট করতে শুরু করেছে । জগদীশবাবু বলেন — আমার এখানে কয়েকটা দিন থাকুন বিরাগীজি । আপনার কাছে এটা আমার প্রাণের অনুরোধ । দুই হাত জোড় করে বিরাগীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন জগদীশবাবু ।
বিরাগী হাসেন — বাইরে খোলা আকাশ থাকতে আর ধরিত্রীর মাটিতে স্থান থাকতে, আমি এক বিষয়ীর দালান বাড়ির ঘরে থাকব কেন, বলতে পারেন ?
বিরাগীজি ! জগদীশবাবুর গলার স্বরের আবেদন করুন হয়ে ছলছল করে ।
বিরাগী বলেন — না, আপনার এখানে জল খেয়েছি, এই যথেষ্ট । পরমাত্মা আপনার কল্যাণ করুন । কিন্তু আপনার এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।
জগদীশবাবু — তবে অন্তত একটু কিছু আজ্ঞা করুন, যদি আপনাকে কোনো ..... ।
বিরাগী —না না, আমি যার কাছে পড়ে আছি, তিনি আপনার চেয়ে কিছু কম নয় । কাজেই আপনার কাছে আমার তো কিছু চাইবার দরকার হয় না ।
জগদীশবাবু — তবে কিছু উপদেশ শুনিয়ে যান বিরাগীজি, নইলে আমি শান্তি পাব না ।
বিরাগী — ধন জন যৌবন কিছুই নয় জগদীশবাবু । ওসব হলো সুন্দর সুন্দর এক-একটি বঞ্চনা । মন-প্রাণের সব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শুধু সেই একজনের আপন হতে চেষ্টা করুন, যাঁকে পেলে এই সৃষ্টির সব ঐশ্বর্য পাওয়া হয়ে যায় । .... আচ্ছা আমি চলি ।
জগদীশবাবু বলেন — আপনি একটা মিনিট থাকুন বিরাগীজি ।
সিঁড়ির উপরে অচঞ্চল হয়ে একটা মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন বিরাগী । আজকের চাঁদের আলোর চেয়েও স্নিগ্ধ হয়ে এক জ্যোৎস্না যেন বিরাগীর চোখ থেকে ঝরে পড়ছে । ভবতোষ ফিসফিস করে — না না, ওই চোখ কী হরিদার চোখ হতে পারে ? অসম্ভব !
জগদীশবাবুর হাতে একটা থলি । থলির ভিতরে নোটের তাড়া । বিরাগীর পায়ের কাছে থলিটাকে রেখে দিয়ে ব্যাকুল স্বরে প্রার্থনা করেন জগদীশবাবু — এই প্রণামী, এই সামান্য একশো এক টাকা গ্রহণ করে আমাকে শান্তি দান করুন বিরাগীজি । আপনার তীর্থ ভ্রমণের জন্য এই টাকা আমি দিলাম ।
বিরাগী হাসেন — আমার বুকের ভিতরেই যে সব তীর্থ । ভ্রমণ করে দেখবার তো কোনো দরকার হয় না ।
জগদীশবাবু — আমার অনুরোধ বিরাগীজি ... ।
বিরাগী বলেন — আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনিই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি ।
বলতে বলতে সিঁড়ি থেকে নেমে গেলেন বিরাগী । একশো এক টাকার থলিটা সিঁড়ির উপরেই পড়ে রইল । সেদিকে ভুলেও একবার তাকালেন না বিরাগী ।
৩
— কী করছেন হরিদা কী হলো ? কই ? আজ যে বলেছিলেন জবর খেলা দেখাবেন, সে কথা কি ভুলেই গেলেন । আজকের সন্ধ্যাটা ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলেন কেন ?
বলতে বলতে আমরা সবাই হরিদার ঘরের ভিতরে ঢুকলাম ।
হরিদার উনানের আগুন তখন বেশ গনগনে হয়ে জ্বলছে । উনানের উপর হাঁড়িতে চাল ফুটছে । আর, একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে হরিদা চুপ করে বসে আছেন । আমাদের দেখতে পেয়েই লজ্জিতভাবে হাসলেন ।
কী আশ্চর্য ! চমকে ওঠে ভবতোষ । —হরিদা, আপনি তাহলে সত্যিই বের হয়েছিলেন । আপনিই বিরাগী ?
হরিদা হাসেন — হ্যাঁ রে ভাই ।
ওই তো সেই সাদা উত্তরীয়টা পড়ে রয়েছে মাদুরের উপর, আর সেই ঝোলাটা আর সেই গীতা ।
অনাদি বলে — এটা কী কাণ্ড করলেন, হরিদা ? জগদীশবাবু তো পাঁচশো টাকা সাধলেন, অথচ আপনি একেবারে খাঁটি সন্ন্যাসীর মতো সব তুচ্ছ করে সরে পড়লেন ?
হরিদা — কী করব বল ? ইচ্ছেই হলো না । শত হোক ...।
ভবতোষ — কী ?
হরিদা — শত হোক, একজন বিরাগী সন্ন্যাসী হয়ে টাকা-ফাকা কী করে স্পর্শ করি বল ? তাতে যে আমার ঢং নষ্ট হয়ে যায় ।
কী অদ্ভুত কথা বললেন হরিদা ! হরিদার একথার সঙ্গে তর্ক চলে না । আর, বুঝতে অসুবিধে নেই, হরিদার জীবনের ভাতের হাঁড়ি মাঝে মাঝে শুধু জল ফুটিয়েই সারা হবে । অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে না ।
অনাদি বলে — কিন্তু আপনি কি জগদীশবাবুর কাছে গিয়ে আর কখনও ...।
চেঁচিয়ে হেসে ওঠেন হরিদা — যাবই তো । না গিয়ে উপায় কী ? গিয়ে অন্তত বকশিশতা তো দাবি করতে হবে ?
বকশিশ ? চেঁচিয়ে ওঠে ভবতোষ । সেটা তো বড়জোর আটা আনা কিংবা দশ আনা ।
হরিদা বিড়ি মুখে দিয়ে লজ্জিত ভাবে হাসেন — কী আর করা যাবে বল ? খাঁটি মানুষ তো নয়, এই বহুরূপীর জীবন এর বেশি কী আশা করতে পারে ?
****