হরমোন সম্পর্কে সাধারণ ধারণা (General Idea of Hormones)
জীবদেহের যে জৈব-রাসায়নিক পদার্থ সারা দেহে রাসায়নিক সমন্বয়সাধন করে তাকেই হরমোন বলা হয় । হরমোন সাধারণত বিশেষ ধরনের কোষ, কলা এবং অন্তঃক্ষরা বা অনালগ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয় । ওই জৈব-রাসায়নিক পদার্থ সাধারণত প্রাণীদের ক্ষেত্রে রক্ত ও লসিকার মাধ্যমে এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্রে জল ও কলারসের মাধ্যমে উত্স স্থল থেকে দূরবর্তী স্থানে বাহিত হয়ে ওই অঞ্চলের কলা-কোষের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্রিয়ার পর ধ্বংস হয়ে যায় । হরমোন প্রধানত প্রোটিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড, স্টেরয়েড প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত । উত্স স্থল ছাড়া দেহের অন্য কোথাও হরমোন সঞ্চিত হয় না ।
হরমোন কথাটি গ্রিক শব্দ হরম্যাসিন [Hormacin] বা হরমাও [Hormas] থেকে উত্পত্তি হয়েছে, যার অর্থ জাগ্রত করা বা উত্তেজিত করা । 1905 খ্রিস্টাব্দে বেলিস [Bayliss] এবং স্টারলিং [Starling] নামে দুই বিজ্ঞানী জীবদেহে প্রথম হরমোনের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন ।
সংজ্ঞা:- প্রোটিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড বা স্টেরয়েডধর্মী যে জৈব-রাসায়নিক পদার্থ, জীবদেহের কোনও বিশেষ কোষগুচ্ছ অথবা অন্তঃক্ষরা বা অনাল গ্রন্থি থেকে স্বল্পমাত্রায় ক্ষরিত হয়ে সাধারণত রক্ত, লসিকা ইত্যাদির মাধ্যমে উত্পত্তি স্থল থেকে দুরে শরীরের কোনও বিশেষ জায়গায় পরিবাহিত হয় এবং সেখানকার কলা-কোষের বিভিন্ন বিপাকীয় কাজের মধ্যে রাসায়নিক সমন্বয়সাধন করে, এবং কাজের শেষে নষ্ট হয়ে যায়, তাকেই হরমোন বলে ।
হরমোনের বৈশিষ্ট্য [Characteristics of Hormones]
[1] প্রকৃতি:- হরমোন একরকম প্রোটিনধর্মী বা স্টেরয়েড বা অ্যামাইনো ধর্মী জৈব রাসায়নিক পদার্থ, যা নিঃসৃত স্থান থেকে দূরবর্তী স্থানে ক্রিয়া করে (ব্যতিক্রম : স্থানীয় হরমোন ) ।
[2] পরিণতি:- হরমোন জৈব অনুঘটকের মতো ক্রিয়া করে, কিন্তু ক্রিয়ার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং দ্রুত সে স্থান থেকে বের হয়ে যায় ।
[3] সঞ্চয়:- নিঃসৃত স্থান ছাড়া দেহের অন্য কোথাও হরমোন সঞ্চিত হয় না ।
[4] পরিমাণ;- হরমোন খুব স্বল্প মাত্রায় ক্রিয়া করে, কিন্তু এই ক্রিয়ার স্থায়িত্বকাল বহুদিন পর্যন্ত থাকে । প্রয়োজনের তুলনায় হরমোন কমবেশি ক্ষরিত হলে জীবদেহে অস্বাভাবিকত্ব দেখা যায় ।
[5] সমন্বয়কারী:- হরমোন জীবদেহে রাসায়নিক সমন্বয়কারী অর্থাৎ কেমিক্যাল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করে ।
[6] বার্তাবহ:- হরমোন কোষে কোষে রাসায়নিক বার্তা প্রেরণ —এই জন্য হরমোনকে রাসায়নিক দূত বা রাসায়নিক বার্তাবহ বা রাসায়নিক মেসেঞ্জার [Chemical messenger] বলে ।
[7] ফিডব্যাক [feed back]:- কোনো একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষরণক্রিয়া পরোক্ষভাবে অন্য গ্রন্থির মাধ্যমে নিজেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে —এই পদ্ধতিকে ফিড-ব্যাক বলা হয় ।
[8] দ্বৈতনিয়ন্ত্রক [Dual controller] :- প্রাণীদেহে কোনো কোনো কার্যক্ষেত্রে কোনও একটি হরমোন কোনও কাজে সহায়তা করে, আবার কোনও একটি হরমোন ওই কাজে বাধা দেয় । এইভাবে হরমোন প্রাণীদেহে দ্বৈত-নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে ।
উৎসেচক ও হরমোনের পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | উত্সেচক | হরমোন |
১. উত্পত্তিস্থল |
উত্সেচক প্রায় সব রকম সজীব কোষে উত্পন্ন হয় । | হরমোন কেবল তরুণ কোষে অথবা অনালগ্রন্থির কোষে উত্পন্ন হয় । |
২. পরিবহন | অনালগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত উত্সেচক নালী পথে বাহিত হয় । | অনালগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমন সরাসরি রক্তে বা লসিকায় মিশে যায় এবং রক্ত বা লসিকা দ্বারা বাহিত হয় । |
৩. কর্মস্থল | উত্সেচক উত্সস্থলে এবং অন্যত্র ক্রিয়া করে । | হরমন উত্সস্থলে ক্রিয়া করে না । উত্সস্থলে থেকে দূরবর্তী স্থানে ক্রিয়া করে (ব্যতিক্রম: স্থানীয় হরমন) । |
৪. কাজের প্রকৃতি | উত্সেচক জৈব অনুঘটকরূপে কাজ করে এবং ক্রিয়ার পর অপরিবর্তিত থাকে । | হরমোন জৈব অনুঘটকরূপে ক্রিয়া করলেও ক্রিয়ার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । |
৫. পরিণতি |
উত্সেচক রাসায়নিক বার্তাবহ রূপে কাজ করে না । |
হরমোন রাসায়নিক বার্তাবহ রূপে কাজ করে । |
*****
- 16753 views