শেরশাহের উত্থান ও রাজত্ব (Rise of Sher Shah)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 09/08/2014 - 17:09

শেরশাহের উত্থান ও রাজত্ব (Rise of Sher Shah)

শেরশাহ (Sher Shah) : মধ্যযুগে ভারতের ইতিহাসে আফগান নেতা শের খাঁ এক বিরল ব্যক্তিত্ব । শের খাঁ তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করেন যে, জন্ম দৈবের অধীন হলেও ভাগ্য নিজের হাতে গড়ে নেওয়া যায় । শূরবংশীয় আফগান শাসক শের খাঁ নিজ গুণে ও আপন প্রতিভায় মধ্যযুগে ভারত ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন । তিনি মোঘল শাসক হুমায়ুনের পতন ঘটিয়ে ভারতে আফগান শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন ।

(ক) পূর্ব জীবন : শেরশাহের আসল নাম ছিল ফরিদ । তিনি সম্ভবত ১৪৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা হাসান ছিলেন সাসারামের জায়গিরদার । ফরিদের বাল্যজীবন সুখের ছিল না । বিমাতার কোপে পড়ে তিনি সাসারাম ছাড়তে বাধ্য হন । পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাসারামের জায়গিরদার রূপে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন । ১৫২২ সালে তিনি বিহারের শাসন কর্তার অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন । এই সময়ে তিনি সহস্তে তিনি একটি বাঘ মেরে শের খান উপাধি পান । কিন্তু তাঁর শত্রুরা তাকে সাসারাম ছাড়তে বাধ্য করেন । তখন তিনি বাবরের অধীনে চাকরি করেন । বাবরই তাঁকে সাসারাম ফিরিয়ে দেন ।

(খ) ক্ষমতা বৃদ্ধি রাজ্য বিস্তার : এরপর শের খান দ্রুত গতিতে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করেন । বিহারের শাসন কর্তা জালাল খান নামে মাত্র বিহারের অধীশ্বর ছিলেন । আসল ক্ষমতা ছিল তাঁর অবিভাবক শের খানের হাতে । চুনার দুর্গ অধীকার করে শের খান আরও ক্ষমতা বৃদ্ধি করলে জালাল খান উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন । তিনি বাংলার সুলতান মামুদ শাহের সঙ্গে মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হয়ে শের খানকে বাধা দিতে চেষ্টা করেন । কিন্তু শের খান ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরজগড় বা কিউলের যুদ্ধে তাঁদের পরাস্ত করে বিহারে নিজের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন । এরপর থেকে শের খানের অগ্রগতি ছিল অব্যাহত । হুমায়ুন যখন গুজরাটে বাহাদুর শাহের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তিনি বাংলা রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন । হুমায়ুন কিন্তু গুজরাট ও মালয় থেকে ফিরে তাঁকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে আগ্রায় অযথা সময় কাটাতে থাকেন । সেই সুযোগে শের খান আবার গৌড় আক্রমণ করেন । তখন হুমায়ুন অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁকে বাধা দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন । কিন্তু পথিমধ্যে তিনি ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে চুনার দুর্গ আক্রমণ করে দখল করেন এবং অযথা সময় নষ্ট করে শের খানকে বাংলার উপর পুরোপুরি প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ করে দেন । এরপর শের খান রোটাস দুর্গ দখল করেন । হুমায়ুন তখন বাংলার দিকে অগ্রসর হয়ে গৌড় অধিকার করেন । শের খান হুমায়ুনের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে বিহার ও জৌনপুর দখল করে কনৌজ অগ্রসর হন । এই অবস্থায় হুমায়ুন বাংলা পরিত্যাগ করে আগ্রা অভিমুখে রওনা হলে শের খান ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের কাছে চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করেন । এর ফলে শের খান কার্যত কনৌজ থেকে আসাম ও হিমালয় থেকে ঝাড়খণ্ড ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিরাট এলাকার অধীশ্বর হন । এরপর তিনি শেরশাহ উপাধি গ্রহণ করেন । হুমায়ুন আবার শেরশাহের সঙ্গে ১৫৪০ সালে কনৌজ বা বিল্বগ্রামের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । কিন্তু এই যুদ্ধে হুমায়ুন আবার পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়ে তিনি পরবর্তী ১৫ বছর ভবঘুরের জীবন যাপন করতে বাধ্য হন । অতঃপর শেরশাহ পাঞ্জাব ও মালয় দখল করেন । রাজপুতদের পরাজিত করে তিনি রাইসিন দুর্গও দখল করেন । ইতিমধ্যে পাঞ্জাবের শাসন কর্তা সিন্ধু ও মুলতান জয় করেন । মারওয়ারের রাজপুত রাজা মালদেব তাঁর কাছে পরাজিত হন । এরপর আজমির থেকে আবু পর্যন্ত সমগ্র এলাকা তাঁর করতলগত হয় ।  অবশেষে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করার সময় এক বিস্ফোরণের ফলে শেরশাহ মৃত্যুমুখে পতিত হন ।

(গ) শের শাহের শাসন রাজস্ব বাবস্থা (Sher Shah's Administrative System and Land-revenue policy) : শেরশাহের রাজত্বকাল মাত্র ৫ বছর স্থায়ী হলেও শাসক হিসাবে তিনি অক্ষয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন । অনেকের মতে বিজেতা অপেক্ষা দক্ষ শাসক হিসাবেই শেরশাহের রাজত্বকাল অধিক গুরুত্বপূর্ণ । ঐতিহাসিক কিনের মতে কোন সরকারই, এমনকি ব্রিটিশ সরকারও শের শাহের মতো শাসন কার্যে বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেন নি । ভিনসেন্ট স্মিথ, ডঃ কানুনগো, ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণও শের শাহের শাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । শের শাহের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে চিরাচরিত ভারতীয় শাসনের— তা সে হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক না কেন, বৈশিষ্ট্যও যেমন দেখা যায়, তেমনি কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন ।

(১) শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য : শেরশাহের শাসনব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা । কিন্তু সমস্ত ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রীভুত থাকলেও তিনি স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না । প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল । শাসনের সুবিধার্থে তিনি সমস্ত রাজ্য ৪৭টি সরকারে ও প্রতিটি সরকার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত ছিল । শাসন কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তরে ছিল গ্রাম । সরকারের শাসনভার ছিল শিকদার-ই-শিকদারানের ওপর । প্রত্যেক পরগণায় একজন আমিন, শিকদার, একজন কোষাধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষক হিসাবে একজন হিন্দু ও একজন ফার্সি কর্মচারী থাকতেন । একজন মুনসিফ–ই–মুনসিফান পরগণার কর্মচারীদের কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করতেন । সরকারি কর্মচারীদের বদলির ব্যবস্থা ছিল ।

(২) ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা (Land-revenue policy) : শেরশাহের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সংস্কার হল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা । ভুমি রাজস্ব ব্যবস্থায় কৃষকের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন । তাঁর নিজের ভাষায় বলি— “আমি যদি কৃষকদের অত্যাচার করি, তাহলে তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে এবং সমস্ত দেশ জনশূন্য ও ধ্বংস হয়ে যাবে ।" প্রতিটি জমি যথাযত জরিপ করার পর খাজনা নির্ধারণ করা হত এবং তা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নগদে বা শস্যে আদায় করা হত । রাজস্বের হার ছিল উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ । রাজস্ব আদায়ের জন্য আমিন, মুকাদ্দম, পাটোয়ারী কানুনগো প্রভৃতি কর্মচারীর সাহায্য নেওয়া হত । রাজস্ব আদায়ে কড়াকড়ি ছিল । কিন্তু কোনো কারণে শস্যের ক্ষতি হলে কর ছাড়ের ব্যবস্থাও ছিল । সম্ভবত কৃষি ঋণের ব্যবস্থাও ছিল । জমিতে কৃষকদের অধিকারের স্বীকৃতি স্বরূপ কবুলিয়ত বা পাট্টার ব্যবস্থা ছিল । শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থার মূল লক্ষ ছিল সরকারের আর্থিক স্বাচ্ছল্য বিধানের সঙ্গে সঙ্গে প্রজার স্বার্থ রক্ষা করা ।

(৩) আর্থিক সংস্কার (Economic Reforms) : রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের দিকেও শের শাহ লক্ষ রেখেছিলেন । তিনি মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করেন ও একটি বলিষ্ঠ শুল্কনীতি গ্রহণ করেন । পরিবহণের উন্নতির জন্য তিনি জি টি রোড সহ কয়েকটি বড়ো বড়ো রাস্তা নির্মাণ করেন । যাত্রীদের সুবিধার্থে রাস্তার ধারে ধারে বৃক্ষরোপণ করা হয় ও সরাইখানা নির্মাণ করা হয় । এই সরাইখানাগুলি আবার ডাকঘর ও সংবাদ আদান-প্রদানের কাজও করত ।

(৪) পুলিশ, বিচার সামরিক বিভাগ : রাজ্যে সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা রাখার জন্য পুলিশি ব্যবস্থাকে সংস্কার করা হয় । গ্রামে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব ছিল গ্রাম প্রধানের হাতে । বিচারকার্যে ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ করা হত না । পরগণায় বিচারের দায়িত্ব পালন করতেন আমিন, কাজী ও মির-ই-অদল । রাজধানীতে প্রধান কাজি বিচারকার্য সম্পাদন করতেন । বিচারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল স্বয়ং সম্রাটের হাতে । সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি আলাউদ্দিনের পথ অনুসরণ করেন । তিনি একটি নিয়মিত বিরাট সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন । প্রতিটি সৈনিক তাঁর প্রতি অনুগত ছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষা করা হত । কোন প্রকার দুর্নীতি সহ্য করা হত না ।

(ঘ) শেরশাহের কৃতিত্ব : মধ্যযুগের ইতিহাসে শেরশাহ নিঃসন্দেহে একজন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য শাসক । সামান্য একজন জায়গিরদারের পুত্র হয়েও তিনি যেভাবে নিজ প্রতিভাবলে নবজাত মুঘল সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটিয়ে পাঠানদের পুনরাভ্যুত্থানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে । তাঁর সামরিক প্রতিভা উল্লেখযোগ্য হলেও ভারতের ইতিহাসে আমরা তাঁর থেকেও দক্ষ ও শক্তিশালী বীরের নাম হয়ত করতে পারি । কিন্তু আকবরের আগে মধ্যযুগের কোনো সুলতানই শাসক হিসাবে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না । বিশেষত যেভাবে তিনি স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে প্রজা বাৎসল্যের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, তার নজির নেই । পরবর্তী যুগে একমাত্র আকবরই তাঁর কৃতিত্বকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ভুললে চলবে না যে, শেরশাহের রাজত্বের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫ বছর এবং শেরশাহের শাসন নীতির অনেক কিছুই আকবর গ্রহণ করেছিলেন । শেরশাহের রাজনীতির প্রশংসা ঐতিহাসিক মাত্রেই করতে বাধ্য হয়েছেন । নির্মাতা ও শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে সাসারামে নির্মিত তাঁর সমাধি আজও বিদ্যমান । সবশেষে শেরশাহ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন । তাঁর সেনাপতি ব্রহ্মজিৎ গৌড় ছিলেন একজন হিন্দু । তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার যে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন, তা মধ্যযুগের ইতিহাসে অতুলনীয় ।

*****

Related Items

ইলতুৎমিস (Iltutmish)

দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইলতুৎমিস । তিনি ১২১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । কুতুবউদ্দিন তাঁকে ক্রীতদাস হিসাবে ক্রয় করেন । পরে তাঁর প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বদাউনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ও নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন । ...

কুতুবউদ্দিন আইবক (Qutb-ud-din Aibak)

১১৯১ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ভারতের অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সাহায্য নিয়ে মহম্মদ ঘুরিকে পরাস্ত করেন । পরের বছর অর্থাৎ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত নিহত করে দিল্লী ও আজমীর দখল করেন ...

সুলতানি আমল (Delhi Sultanate)

সুলতানি আমলে পর পর পাঁচটি রাজবংশ দিল্লির সিংহাসনে ক্ষমতাসীন ছিল । সেই পাঁচটি রাজবংশ হল - ইলবেরি তুর্কি বংশ বা দাসবংশ, খলজি বংশ, তুঘলক বংশ, সৈয়দ বংশ, লোদী বংশ। সুলতানি আমলে বলপূর্বক ও হত্যা করে সিংহাসন দখল করা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা ...

মহম্মদ ঘুরি (Muhammad Ghori)

আফগানিস্তানের গজনী ও হিরাটের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ঘোর রাজ্য । সেই সময় উত্তর ভারতের হিন্দু রাজাদের মধ্যে কোনো ঐক্য ছিল না । এই সব হিন্দু রাজাদের মধ্যে আজমীর ও দিল্লির অধিপতি পৃথ্বীরাজ চৌহান ও কনৌজ-রাজ জয়্চাঁদ ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী ...

সুলতান মামুদ (Sultan Mahmud of Gazni)

মহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু জয়ের ৩০০ বছর বাদে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গজনির সুলতান মামুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন । সুলতান মামুদ একজন লোভী, লুন্ঠনকারী, রূপেই পরিচিত । ভারতে রাজ্য স্থাপনের কোনো ইচ্ছা তার ছিল না । ইসলাম ধর্মের প্রসার ...