মহম্মদ বিন তুঘলক

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 09/06/2014 - 08:19

মহম্মদ বিন তুঘলক (Muhammad bin Tughluq) :

খলজি বংশের অবসানের পর তুঘলকি আমল শুরু হয় । তুঘলকি বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গিয়াসউদ্দিন তুঘলক । গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জুনা খাঁ মহম্মদ-বিন-তুঘলক নাম নিয়ে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । মহম্মদ-বিন-তুঘলক ছিলেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান । সম্ভবত তিনি তাঁর পিতাকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন । পরবর্তীকালে তিনি কয়েকটি প্রশাসনিক সংস্কার করেন ।

(১) রাজধানী স্থানান্তর (Transfer of Capital) : মহম্মদ বিন তুঘলকের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হল দিল্লি থেকে রাজধানী দেবগিরিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া । এই পরিকল্পনার মধ্যে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের বুদ্ধিমত্তার ছাপ ছিল । প্রথমত, দেবগিরি দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত ছিল বলে এখান থেকে সমগ্র দেশের ওপর লক্ষ রাখা অনেক সহজ ছিল । দ্বিতীয়ত, মোঙ্গল আক্রমণ থেকে দেবগিরি অনেক বেশি সুরক্ষিত ছিল । সর্বপরি, দাক্ষিণাত্যে ইসলাম ধর্ম সম্প্রসারণেও দেবগিরির অবস্থান ছিল সুবিধা জনক । কিন্তু এই পরিকল্পনা কার্যকরী করতে গিয়ে একের পর এক ভুল করেছিলেন । প্রথমত, দিল্লি থেকে দেবগিরি বা দৌলতবাদের দূরত্ব এবং গ্রীষ্মকালে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করায় যারা দিল্লি থেকে নতুন রাজধানীর দিকে রওনা হয়েছিল, তাদের কষ্টের শেষ ছিল না । এর ফলে প্রজাদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল । কিন্তু দিল্লি থেকে সমস্ত অধিবাসীকে জোর করে নতুন রাজধানীতে পাঠানো হয়েছিল বলে যে অভিযোগ করা হয়, তা সর্বৈব মিথ্যা । দ্বিতীয়ত, দিল্লি থেকে দক্ষিণ ভারত নিয়ন্ত্রণ করা যেমন কষ্টসাধ্য ছিল, তেমনি দেবগিরি থেকেও উত্তর ভারত, বিশেষত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নজর রাখা কঠিন ছিল । তাই শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয় ।  রাজধানী আবার দিল্লিতেই স্থানান্তরিত হয় । এই পরিকল্পনা পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছিল বলা যায় না । কারণ এর ফলে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যোগাযোগের পথ খুলে যায় ।

(২) প্রতীকী মুদ্রার প্রচলন (Introduction of Token Currency) : মহম্মদ বিন তুঘলকের আর একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হল তামার টাকা প্রচলন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা আসলে রূপার পরিমান ও সরবরাহ কমে যাওয়ার তিনি রূপোর বদলে তামার টাকা চালু করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দেননি । লোকে টাকা যাতে জাল না করতে পারে, তিনি তার ব্যবস্থা না করায় বাজার জাল নোটে ছেয়ে গিয়েছিল এবং এইসঙ্গে তাঁর পরিকল্পনাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল । তবে তিনি দ্রুত এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

(৩) দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি (Increase of Land-revenue in Doab) : ভূমিরাজস্ব সংস্কারের ক্ষেত্রেও সুলতান বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দেননি । তিনি দোয়াব অঞ্চলের কৃষকদের ভূমিরাজস্বের হার অনেক বাড়িয়ে দেন । কিন্তু ঠিক সেই সময়ই ওই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ চলছিল বলে কৃষকদের পক্ষে এই বাড়তি করের বোঝা বহন করা সম্ভব হয়নি । তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল । সরকার যখন কৃষকদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, তখন অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল ।

(৪) রাজ্যজয় নীতি : সুলতানের খোরাসান ও ইরাক জয়ের পরিকল্পনাও সফল হয়নি । অবশ্য মোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকে তিনি ভারতকে রক্ষা করতে সক্ষম হন । কারাচল অভিযানের ক্ষেত্রে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্বেও তা সফলতার রূপ পেয়েছিল । নাগরকোট অভিযানের ক্ষেত্রেও তিনি সফল হয়েছিলেন । কিন্তু তাঁর বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে দেশে চতুর্দিকে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয় । বাংলা, সিন্ধু, মুলতান, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয় । এই সমস্ত বিদ্রোহ দমন করতে তাঁকে হিমসিম খেতে হয় । এই বিদ্রোহ দমনের জন্য ১৩৫১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সিন্ধু অভিযান করেন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন ।

(৫) মহম্মদ বিন তুঘলকের মূল্যায়ন (Assessment of Muhammad bin Tughluq) : মহম্মদ বিন তুঘলকের চরিত্র, কার্যাবলী ও কৃতিত্বকে কেন্দ্র করে সমকালীন এবং আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক ও মতভেদ আছে । তাঁর পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক ঔদার্য, সংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সর্বধর্মসহিষ্ণু মনোভাব, উদারতা এবং আদর্শবাদ আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে । কিন্তু তাঁর ধৈর্য ও বাস্তব জ্ঞানের অভাব ছিল । নিষ্ঠুর ও অসহিষ্ণু বলেও তাঁর অখ্যাতি ছিল । কারোও মতে, তিনি ছিলেন খামখেয়ালি এবং পরস্পর বিরোধী দোষ-গুণের মানুষ । কেউ কেউ তাঁকে বিকৃত মস্তিষ্ক এবং উম্মাদ বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি । সমকালীন ঐতিহাসিকদের মধ্যে জিয়াউদ্দিন বরানি, ইসামি, ফেরিস্তা এবং আরব পর্যটক ইবন বতুতা তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছেন । আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে এলফিণ ষ্টোন, লেনপুল, শ্রীবাস্তব প্রমুখরা তাঁর বিরূপ সমালোচনা করেছেন । ঈশ্বরীপ্রসাদ এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজামি অবশ্য ভিন্ন দৃষ্টিতে তাঁর মূল্যায়ন করেছেন । সামগ্রিক বিচারে তিনি ব্যর্থ হন । তাঁর ২৬ বছরের রাজত্বকাল হল একের পর এক এমন সব পরিকল্পনার ইতিহাস যার মধ্যে তাঁর উদ্ভাবনী ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিফলিত হয়েছিল; কিন্তু সেগুলির রূপায়ণে তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলি দুঃখজনকভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল ।

(৬) মহম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্ব : মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন সুলতানি যুগের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব । তাঁর অধিকাংশ পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয় । কিন্তু ব্যর্থতার মাপকাঠিতে মহম্মদ বিন তুঘলককে বিচার করলে ভুল হবে । পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক নরপতির কথা জানা যায় যাঁরা মহৎ উদ্দেশ্য থাকা সত্বেও সফল হতে পারেননি । কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাঁরা ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং অনেক সময় শ্রেষ্ঠ সম্রাটের মর্যাদাও পেয়েছেন । মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন এই শ্রেণিভুক্ত । তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা ছিল সমকালীন যুগের থেকে অগ্রবর্তী । তাঁর পরিকল্পনাগুলির মধ্যে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় । আলাউদ্দিন খলজি বিজেতা ও কঠোর শাসক হিসাবে নিঃসন্দেহে মহম্মদ বিন তুঘলকের চেয়ে অনেক বেশী সফল ছিলেন । কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা, আদর্শ বাদ, পাণ্ডিত্য ইত্যাদির বিচারে মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁকে অনেক ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ওলন্দাজ বণিকদের কার্যকলাপ

সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা এশীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে । গোড়ার দিকে এরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল । কিন্তু এরা অচিরেই বুঝতে পারে যে, মশলা ...

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...