মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System)

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 09/12/2014 - 09:18

মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System) :

মনসবদারি প্রথা (Mansabdari System) : মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল সামরিক শাসন । জনগণের সেখানে কোন ভূমিকা ছিল না । জনসমর্থন নয়, ভীতিই ছিল এই শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য, যদিও আগেই বলা হয়েছিল যে, প্রজা কল্যাণ ছিল এর মুখ্য আদর্শ । শাসনব্যবস্থার শীর্ষে থাকতেন সম্রাট । কিন্তু তাঁর শক্তির প্রধান উৎস ছিল অভিজাত সম্প্রদায় । এরাই ছিল শাসক শ্রেণি । মুঘল রাষ্ট্র সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হলেও এর কোন নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল না । মুঘল সম্রাট সামরিক শক্তির জন্য মনসবদের উপর নির্ভরশীল ছিল । ‘মনসব’ কথাটির অর্থ হল পদ । কোন নির্দিষ্ট পদ বা মনসবের অধিকারকে বলা হত মনসবদার । মনসবদাররা মূলত সামরিক দায়দায়িত্ব পালন করলেও সামরিক ও বেসামরিক উভয় দায়িত্বই তাদের পালন করতে হত । মনসবদারদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনাবাহিনী গঠন করতে হত এবং ১০ থেকে ১০,০০০ সৈনিকের ভিত্তিতে তাদের পদমর্যাদা ঠিক করা হত । অর্থাৎ, একজন মনসবদারের অধীনে যত সৈন্য ও ঘোড়া থাকত, সেই সংখ্যা অনুযায়ী তাকে তত হাজারি মনসবদার বলা হত । সাধারণত দশ হাজার মনসবদারি পদ কেবলমাত্র রাজ পরিবারের কোন সন্তান অথবা সম্রাটের বিশেষ অনুগ্রহ প্রাপ্ত ব্যক্তিকেই প্রদান করা হত । যুদ্ধের প্রয়োজনে মনসবদাররা সম্রাটকে তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করত । কিন্তু সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ, অস্ত্রশস্ত্র বা ঘোড়ার জোগান— এর সবকিছুই মনসবদারকে করতে হত । এর জন্য অবশ্য সরকার থেকে তাদের বেতন দেওয়া হত । অনেক সময় এই বেতন দেওয়া হত নগদ টাকায় । এই সব মনসবদারকে বলা হত ‘মনসব-ই-নগদি’ । কিন্তু অনেক সময় নগদ বেতনের পরিবর্তে তাদের জায়গির বা জমি দেওয়া হত এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী জমি থেকে প্রাপ্ত আয় ছিল তাদের বেতনের সমতুল । অর্থাৎ, এরা ছিল একই সঙ্গে মনসবদার এবং জায়গিরদার । জমির উপর তাদের অবশ্য কোন চিরস্থায়ী অধিকার বা মালিকানা থাকত না এবং চাকরির শর্ত অনুযায়ী তারা এক জায়গির থেকে অন্য জায়গিরে বদলি হত । মনসবদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, অপসারণ এর সবকিছুই নির্ভর করত সম্রাটের মর্জির উপর । মনসবদারদের পুত্র সবসময় মনসবদার হতে পারত না, যদিও যোগ্যতা থাকলে পিতার স্থালাভিষিক্ত হতে বাধা থাকত না । এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা সবটাই নির্ভর করত সম্রাটের দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর । মনসবদারদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে বা তারা বিদ্রোহ করলে, সৈনিকরা সম্রাটের পক্ষে যুদ্ধ না করে মনসবদারের পক্ষ নিত; কারণ তাদের কাছে তিনিই ছিলেন কাছের মানুষ । সম্রাটকে তারা চিনত না ।

রাজস্ব ব্যবস্থা (Land-Revenue System) : আকবরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হল ভূমি রাজস্ব সংস্কার । তাঁর প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থা ‘জাবতি’ ব্যবস্থা নামে খ্যাত । জমি জরিপ হল এই ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । জমির উৎপাদিকা শক্তির ভিত্তিতে রাজস্বের হার ঠিক করা হত । উৎপন্ন শস্যের এক তৃতীয়াংশ ছিল সম্রাটের প্রাপ্য । রাজস্ব আদায় হত নগদ টাকায় । প্রাকৃতিক কোন কারণে শস্যহানি হলে ছাড়ের ব্যবস্থা ছিল । রাজস্ব নির্ধারণের জন্য জমিকে চার ভাগে ভাগ করা হত—

(১) যে সব জমিতে প্রতি বছর চাষ করা হত তাকে বলা হত ‘পোলাজ’ ।

(২) পতিত বা অনাবাদী জমিকে বলা হত ‘পরাতি’ ।

(৩) যে সব জমি দুই বা তিন বছর অনাবাদী থাকত, তাকে বলা হত ‘চাচর’ ।

(৪) যদি তা আরও দীর্ঘদিন অনাবাদী থাকত, তবে তাকে বলা হত ‘বঞ্জর’ । অনাবাদী জমিকে কৃষির আওতায় নিয়ে আসার জন্য আকবর উৎসাহ দিতেন । কৃষির উন্নতির দিকেও সরকারের নজর ছিল । প্রয়োজনে কৃষিঋণের ব্যবস্থাও ছিল । আকবরের ভূমি ব্যবস্থায় কৃষক ও সরকার উভয়েই উপকৃত হত ।

*****

Related Items

আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - দক্ষিণ ভারত

বাতাপির চালুক্য বংশ - উত্তর মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভে বাকাটকদের পতনের পর চালুক্য বংশের উদ্ভব হয় । রাষ্ট্রকূট বংশ - চালুক্যদের পতনের পর রাষ্ট্রকূটদের উদ্ভব হয় । কল্যাণীর চালুক্য বংশ - রাষ্ট্রকূট বংশের শেষ রাজা দ্বিতীয় কর্ককে, কাঞ্চীর পল্লব বংশ- সাতবাহন বংশের পতনের পর কৃষ্ণা থেকে ...

বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - বাংলা

শশাঙ্ক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে বাংলা প্রথম সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে । পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের সুযোগ্য পুত্র ধর্মপাল ...

আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - পশ্চিম ও উত্তর ভারত

বলভীর মৈত্রিক বংশ, যশোধর্মণ, কনৌজের উত্থান - মৌখরী বংশ, পুষ্যভূতি বংশ ও হর্ষবর্ধন, প্রতিহার বংশ, হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রতিহার বংশ উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রভাব শালী হয়ে পড়ে। প্রতিহার বা গুর্জর প্রতিহাররা ছিল রাজপুত জাতির একটি শাখা । এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ...

গুপ্ত সাম্রাজ্য (Gupta Dynasty)

কুষাণ ও সাতবাহন উভয় সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হলেও অয়তনের দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজের তুলনায় ছোটো ছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রধানত বিহার ও উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল । বিহার অপেক্ষা উত্তর প্রদেশই ছিল এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং গোড়ার ...

সাতবাহন সাম্রাজ্য (Satabahanas dynasty)

দাক্ষিণাত্য ও মধ্য ভারতে মৌর্যদের প্রভাব খুবই কম ছিল । অশোকের মৃত্যুর পর দাক্ষিণাত্যে মৌর্যদের আধিপত্য শেষ হয়ে যায় । কিন্তু যাতায়াতের অসুবিধা ও এখানকার অনুন্নত অর্থনীতি গোড়ার দিকে এই অঞ্চলকে বিদেশি আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখে । ফলে খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতক থেকে সাতবাহন ...