ফিরোজ শাহ তুঘলক (Firuz Shah Tughluq)

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 09/06/2014 - 11:45

ফিরোজ শাহ তুঘলক (Firuz Shah Tughluq) :

মহম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর খুড়তুতো ভাই ফিরোজ শাহ তুঘলক আমির-ওমরাহ এবং ধর্মীয় নেতাদের অনুরোধে ৪৬ বছর বয়সে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মার্চ দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । বিজেতা বা শাসক হিসাবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেনি । মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন ন্যায়-পরায়ণ, দয়াশীল ও শান্তিপ্রিয় । প্রজাবৎসল ও মহানুভব শাসক হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল ।  কিন্তু তাঁর দুর্বল নীতি ও ধর্মগুরুদের তোষণ দিল্লি সুলতানির স্বার্থের পক্ষে সহায়ক ছিল না । তবু দিল্লী সুলতানিকে আসন্ন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে তিনি তাকে নবজীবন দান করতে সক্ষম হয়েছিল ।

(১) ফিরোজ শাহের শাসন সংস্কার (Administrative reforms of Firuz Shah Tughluq) : শাসনকার্য পরিচালনায় ফিরোজ শাহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর পূর্বসূরিদের নীতি পরিত্যাগ করেন । তিনি আমীর, ওমরাহ, সেনাবাহিনী এবং উলেমাদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখার পক্ষপাতী ছিলেন । তিনি বংশানুক্রমিক ইকতা প্রথা চালু করে অভিজাত সম্প্রদায়কে খুশি করলেও মেধার গুরুত্ব অস্বীকৃত হয় এবং পরে যোগ্য লোকের অভাব দেখা দেয় । সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও এই উত্তরাধিকার নীতি অনুসৃত হয় । সৈনিকদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জমি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় । এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর দক্ষতা হ্রাস পায় । এর ফলে বিজেতা হিসাবে তিনি চরম ব্যর্থ হন । বাংলায় তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহ দমন করতে তিনি ব্যর্থ হন । অবশ্য জাজনগর (ওড়িশা), নাগরকোট ও সিন্ধুপ্রদেশের কিছু অংশ পুনরাধিকার করতে সক্ষম হন । কিন্তু দাক্ষিণাত্য পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে তিনি কোন চেষ্টাই করেন নি । তাঁর আমলে উলেমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় । সুলতানের ধর্মভীরু মনোভাবের ফলে ভারত একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় । তিনি ব্রাহ্মণদের জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করেন ।

(২) জনহিতকর কার্যাবলী (Benevolent measures) : ফিরোজ শাহ প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন এবং বহু অন্যায় কর তিনি রহিত করেন ।

(ক) ইসলামের বিধান অনুসারে কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন । ব্যবসায়ীদের কয়েকটি অন্যায় ও ভারী করের বোঝা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় । ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটে । সরকারী কর্মচারীরা যাতে কর আদায়ে কোনরকম অত্যাচার না করে এবং প্রাপ্য করের অধিক আদায় না করে, সেদিকে তিনি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন । এর জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল ।

(খ) কৃষির উন্নতির জন্য তিনি কয়েকটি খাল খনন করেন ।

(গ) দরিদ্র জনগণের চিকিৎসার জন্য তিনি দিল্লিতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন ।

(ঘ) বেকার যুবকদের চাকরির সুব্যবস্থা করেন ।

(ঙ) দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিবাহের জন্য সরকারী সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয় । অনাথ ও বিধবাদেরও অর্থ সাহায্য দেওয়া হত । তবে খুব সম্ভবত দরিদ্র অথচ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলির জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল ।

(চ) বিচারের ক্ষেত্রে অপরাধীদের নিষ্ঠুর শাস্তিদানের প্রথা রদ করেন ।

(ছ) নির্মাতা হিসাবে ফিরোজ শাহের খ্যাতি ছিল । তিনি কয়েকটি নগর পত্তন করেন এবং বহু উদ্যানও নির্মাণ করেন ।

(জ) গোঁড়া মুসলমান হলেও তিনি বহু হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও সংগীত শাস্ত্র ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা করেন । তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজিত ছিল ।

(৩) ফিরোজ শাহের মূল্যায়ন : সমসাময়িক ঐতিহাসিক বরানিআফিফ মুক্তকণ্ঠে ফিরোজ শাহের প্রশংসা করেছেন । প্রজাহিতৈষী শাসক হিসাবে তাঁর কৃতিত্ব অবশ্যই অনস্বীকার্য । কিন্তু সার হেনরি এলিয়ট তাঁকে ‘সুলতানি যুগের আকবর’ বলে যেভাবে উচ্চপ্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন, তা অতিশয়োক্তি দোষে দুষ্ট । আকবরের সঙ্গে তাঁর কোনো দিক থেকেই তুলনা করা যায় না । আকবরের মতো উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধর্মসহিষ্ণুতার মনোভাব ফিরোজ শাহের ছিল না । সামরিক নেতা হিসাবে ফিরোজ শাহ ছিল একেবারেই ব্যর্থ । দিল্লি সুলতানির পতনের জন্য তাঁর দুর্বল নীতি বহুলাংশে দায়ী ছিল ।

*****

Related Items

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার সম্পর্ক

সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক যুগের কী সম্পর্ক ছিল, তা বলা কঠিন। অনেকেই মনে করেন আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণকর্তা । বিষয়টি বিতর্কিত । কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে তফাত এত বেশি যে, দুটি সভ্যতা একই জাতি সৃষ্টি করেছিল বলে মনে হয় না । স্যার জন মার্শাল মনে করেন ...

সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক

সিন্ধু জনগণ কূপমন্ডূক ছিল না । সমকালীন অন্যান্য সভ্যতা মিশর, ব্যাবিলন ও সুমেরীয় বা মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সিন্ধু জনগণের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল । সিন্ধু ও সুমেরীয় উভয় সভ্যতাই উন্নত নাগরিক জীবন ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের স্বাক্ষর বহন করে । উভয় অঞ্চলের মানুষ ...

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা (The Indus Valley Civilisation)

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন । তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেন ...

ধাতুর আবিষ্কার ও তাম্রযুগ

নব্য প্রস্তর যুগের অবসান হওয়ার পর ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় । তবে কোথায় নব্যপ্রস্তর যুগের অবসান আর কোথায় ধাতব যুগের সূত্রপাত তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের উত্তরণ হয়েছিল খুব ধীরে ধীরে । ধাতুর ব্যবহার ভারতের সর্বত্র একসঙ্গে হয়নি । উত্তর ভারতে প্রস্তর ...

মেহেরগড় সভ্যতা (Mehrgarh Civilisation)

হরপ্পা সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগের যে সব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মেহেরগড় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হরপ্পা সভ্যতার কিছু কিছু লক্ষণ এই সভ্যতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বলে অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন । সভ্যতার বৈশিষ্ঠ, মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব ...