দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 10/31/2014 - 22:52

দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা :

১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সূচিত হয় এবং ভারতের ঐক্য বিনষ্ট হয় । দিকে দিকে আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব হয় । অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না । মুঘলদের স্থলাভিষিক্ত করা হবে, তার কোন সুস্পষ্ট ছবি ফুটে না উঠলেও এটা বোঝা গিয়েছিল যে, দেশীয় কোনো শক্তি নয়, ইংরেজরাই মুঘলদের উত্তরাধিকারী হতে চলেছে । এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল দাক্ষিণাত্য ও বাংলা থেকে ।

দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা : ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কায়েম করতে গিয়ে ইংরেজদের দুটি বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিল । প্রথমত, একের পর এক দেশীয় শক্তির সঙ্গে তাদের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল । এ কাজ ছিল সময়সাপেক্ষ এবং সহজসাধ্য ছিল না । বস্তুত, সমস্ত দেশীয় শক্তিকে তারা কোনো দিনই পরাস্ত করতে পারেনি বা তা করবার সুযোগ পায়নি । দ্বিতীয়ত, প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ওলন্দাজ ও ফরাসিরা । ভারতে প্রথম সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন ইংরেজরা নয় ফরাসিরা । ওলন্দাজদের বাধা অতিক্রম করতে অবশ্য ইংরেজদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি । কিন্তু ফরাসিদের সঙ্গে তাদের জোরদার লড়াই হয়েছিল । শেষ পর্যন্ত ফরাসিরা পরাজিত হয় । এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রণাঙ্গন ছিল দাক্ষিণাত্য ও বাংলা ।  

দাক্ষিণাত্যে করমণ্ডল উপকূলে ইংরেজদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল মাদ্রাজ বর্তমানে চেন্নাই । তাছাড়া ছিল ফোর্ট সেন্ট ডেভিড । ফরাসিদের প্রধান ঘাঁটি ছিল পণ্ডিচেরি । তাছাড়া ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দে মাহেতে ও ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কারিকলেও ফরাসি কুঠি ছিল । এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন কর্ণাটকের নবাব । তিনি হায়দরাবাদের নিজামের অধীন ছিলেন । ভারতীয় শাসকরা ইউরোপীয়দের বাণিজ্যিক কার্যকলাপে বাধা দিতেন না, বরং উৎসাহ দিতেন । কর্ণাটকের নবাবও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না । বাণিজ্যিক প্রশ্নে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে রেষারেষি ছিল । কিন্তু ১৭৪০ এর দশকে এই রেষারেষি এক নতুন মাত্রা পায় এবং উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । এর জের চলেছিল ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত । প্রথমে অবশ্য কোন পক্ষই ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের কথা চিন্তা করেনি । কিন্তু বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ঘটনাচক্রে যা প্রথমে শুরু হয়েছিল, পরে তা সাম্রাজ্য স্থাপনের বৃহত্তম প্রশ্নে রূপান্তরিত হয় । আর এইভাবে ভারতে আধিপত্য বিস্তারে ইংরাজ ও ফরাসিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে ।  

ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপট : দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হলে দুই বণিক সংস্থার বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি আরও দুটি বাস্তব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ প্রয়োজন । প্রথমটি হল সমসাময়িক দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জটিলতা এবং অপরটি হল সমকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত । দাক্ষিণাত্যে এই সময় এক চরম নৈরাজ্য চলছিল । মুঘল রাজশক্তির পতনের পর এখানে শুরু হয়েছিল নিজাম মারাঠা প্রতিদ্বন্দ্বিতা । অন্যদিকে কর্ণাটকের নবাব নিজামের অধীন হলেও কার্যত স্বাধীন ছিল । কিন্তু ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে মারাঠারা কর্ণাটক আক্রমণ করে নবাব দোস্ত আলিকে হত্যা করেন । তাঁর জামাতা চাঁদ সাহেব কারারুদ্ধ হন । এই অবস্থায় নিজাম কর্ণাটকে এসে আনোয়ারউদ্দিন নামে তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচরকে সিংহাসনে বসান । দোস্ত আলির আত্মীয়স্বজন এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি । অন্যদিকে ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে ইউরোপে শুরু হয় অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ যাতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে এই যুদ্ধের অবসান হলেও ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপে আবার যুদ্ধ শুরু হয় । সপ্তবর্ষব্যাপী এই যুদ্ধেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরস্পর দুই বিরোধী পক্ষে ছিল । ভারতে এই দুই যুদ্ধের ছায়া পড়েছিল । কর্ণাটকে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার তিনটি পর্ব ছিল— (১) প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধ (১৭৪৩-৪৮), (২) দ্বিতীয়ত কর্ণাটক যুদ্ধ (১৭৪৯-৫৪) এবং (৩) তৃতীয় কর্ণাটক যুদ্ধ (১৭৫৭-৬৩) ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...

মুঘল যুগে ভারতের কৃষি নির্ভর শিল্প

মুঘল আমলে গ্রামীন অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প বা কুঠির শিল্প । কুঠির শিল্পকে দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে । প্রথমত, কৃষিনির্ভর শিল্প এবং দ্বিতীয়ত অকৃষি শিল্প । কৃষিনির্ভর শিল্পের মধ্যে পড়বে শর্করা শিল্প, তৈল, তামাক, নীল, মদ প্রভৃতি শিল্প । ...