দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা :
১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সূচিত হয় এবং ভারতের ঐক্য বিনষ্ট হয় । দিকে দিকে আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব হয় । অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না । মুঘলদের স্থলাভিষিক্ত করা হবে, তার কোন সুস্পষ্ট ছবি ফুটে না উঠলেও এটা বোঝা গিয়েছিল যে, দেশীয় কোনো শক্তি নয়, ইংরেজরাই মুঘলদের উত্তরাধিকারী হতে চলেছে । এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল দাক্ষিণাত্য ও বাংলা থেকে ।
দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা : ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কায়েম করতে গিয়ে ইংরেজদের দুটি বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিল । প্রথমত, একের পর এক দেশীয় শক্তির সঙ্গে তাদের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল । এ কাজ ছিল সময়সাপেক্ষ এবং সহজসাধ্য ছিল না । বস্তুত, সমস্ত দেশীয় শক্তিকে তারা কোনো দিনই পরাস্ত করতে পারেনি বা তা করবার সুযোগ পায়নি । দ্বিতীয়ত, প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ওলন্দাজ ও ফরাসিরা । ভারতে প্রথম সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন ইংরেজরা নয় ফরাসিরা । ওলন্দাজদের বাধা অতিক্রম করতে অবশ্য ইংরেজদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি । কিন্তু ফরাসিদের সঙ্গে তাদের জোরদার লড়াই হয়েছিল । শেষ পর্যন্ত ফরাসিরা পরাজিত হয় । এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রণাঙ্গন ছিল দাক্ষিণাত্য ও বাংলা ।
দাক্ষিণাত্যে করমণ্ডল উপকূলে ইংরেজদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল মাদ্রাজ বর্তমানে চেন্নাই । তাছাড়া ছিল ফোর্ট সেন্ট ডেভিড । ফরাসিদের প্রধান ঘাঁটি ছিল পণ্ডিচেরি । তাছাড়া ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দে মাহেতে ও ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কারিকলেও ফরাসি কুঠি ছিল । এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন কর্ণাটকের নবাব । তিনি হায়দরাবাদের নিজামের অধীন ছিলেন । ভারতীয় শাসকরা ইউরোপীয়দের বাণিজ্যিক কার্যকলাপে বাধা দিতেন না, বরং উৎসাহ দিতেন । কর্ণাটকের নবাবও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না । বাণিজ্যিক প্রশ্নে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে রেষারেষি ছিল । কিন্তু ১৭৪০ এর দশকে এই রেষারেষি এক নতুন মাত্রা পায় এবং উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । এর জের চলেছিল ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত । প্রথমে অবশ্য কোন পক্ষই ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের কথা চিন্তা করেনি । কিন্তু বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ঘটনাচক্রে যা প্রথমে শুরু হয়েছিল, পরে তা সাম্রাজ্য স্থাপনের বৃহত্তম প্রশ্নে রূপান্তরিত হয় । আর এইভাবে ভারতে আধিপত্য বিস্তারে ইংরাজ ও ফরাসিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে ।
ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপট : দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হলে দুই বণিক সংস্থার বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি আরও দুটি বাস্তব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ প্রয়োজন । প্রথমটি হল সমসাময়িক দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জটিলতা এবং অপরটি হল সমকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত । দাক্ষিণাত্যে এই সময় এক চরম নৈরাজ্য চলছিল । মুঘল রাজশক্তির পতনের পর এখানে শুরু হয়েছিল নিজাম মারাঠা প্রতিদ্বন্দ্বিতা । অন্যদিকে কর্ণাটকের নবাব নিজামের অধীন হলেও কার্যত স্বাধীন ছিল । কিন্তু ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে মারাঠারা কর্ণাটক আক্রমণ করে নবাব দোস্ত আলিকে হত্যা করেন । তাঁর জামাতা চাঁদ সাহেব কারারুদ্ধ হন । এই অবস্থায় নিজাম কর্ণাটকে এসে আনোয়ারউদ্দিন নামে তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচরকে সিংহাসনে বসান । দোস্ত আলির আত্মীয়স্বজন এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি । অন্যদিকে ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে ইউরোপে শুরু হয় অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ যাতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে এই যুদ্ধের অবসান হলেও ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপে আবার যুদ্ধ শুরু হয় । সপ্তবর্ষব্যাপী এই যুদ্ধেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরস্পর দুই বিরোধী পক্ষে ছিল । ভারতে এই দুই যুদ্ধের ছায়া পড়েছিল । কর্ণাটকে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার তিনটি পর্ব ছিল— (১) প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধ (১৭৪৩-৪৮), (২) দ্বিতীয়ত কর্ণাটক যুদ্ধ (১৭৪৯-৫৪) এবং (৩) তৃতীয় কর্ণাটক যুদ্ধ (১৭৫৭-৬৩) ।
*****
- 4076 views