খলজি বংশ ও আলাউদ্দিন খলজি

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 05/07/2012 - 15:21

খলজি বংশ ও আলাউদ্দিন খলজি :

খলজি বংশ : ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী দাস বংশের শেষ তুর্কি সুলতান কাইকোবাদ ও  তাঁর শিশুপুত্র কাইমুর্সকে হত্যা করে প্রধান সেনাপতি জালালউদ্দিন খলজি ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান হন । জালালউদ্দিন খলজির দিল্লি দখলের সঙ্গে সঙ্গে দাস বংশের (Slave dynasty) অবসান ঘটে ও খলজি বংশের (Khalji dynasty) সূচনা হয় । 

জালালউদ্দিন খলজি (Jalaluddin Firoz Khalji) : জালালউদ্দিন খলজি ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসেন । তিনিই ছিলেন খলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা । মোঙ্গল নেতা হালাকু প্রচন্ডভাবে জালালউদ্দিন খলজিকে বিরক্ত করেন । মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হবেন এই শর্তে জালালউদ্দিন খলজি প্রায় ৪০০০ মোঙ্গলকে দিল্লির আশেপাশে বসবাস করার অনুমতি দিয়েছিলেন । জালালউদ্দিন খলজির প্রিয় পাত্র ছিলেন তাঁর ভাইপো ও জামাতা আলাউদ্দিন খলজি । ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খলজি এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে জালালউদ্দিন খলজিকে নিহত করেন ।  

আলাউদ্দিন খলজি (Alauddin Khalji) : নিজ পিতৃব্যখলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন খলজিকে হত্যা করে আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন । তিনি ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ইলবেরি তুর্কি আমলে ভারতে দিল্লি সুলতানির যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, আলাউদ্দিন খলজির সময় তা পরিপূর্ণ রূপ গ্রহণ করেছিল । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার চালু করে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । এই দিক দিয়ে বিচার করলে তাঁকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যেতে পারে ।

আলাউদ্দিন খলজির রাজ্যজয় (Expansion of the Delhi Sultanate) : আলাউদ্দিন খলজি খুব উচ্চাকাঙক্ষী ছিলেন । গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের মতো তিনিও বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন । কিন্তু কাজি আলা-উল-মূলকের পরামর্শে তিনি এই অসম্ভব পরিকল্পনা ত্যাগ করে সারা ভারত জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন । বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করলেও তিনি তাঁর মুদ্রায় নিজেকে 'দ্বিতীয় আলেকজান্ডার' হিসাবে উল্লেখ করতেন । ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকেও ভারতকে রক্ষা করেন । প্রথমে তিনি ভারতের গুজরাটের রাজা কর্ণদেব, রণ-থম্ভোরের রাজপুত নেতা হামির দেব, মেবারের রাজা রতন সিং ও মালবের অধিপতি মহ্লক দেবকে পরাজিত করেন । এরপর তিনি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন । কাফুর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র, বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ প্রতাপ রুদ্র, দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ তৃতীয় বল্লালকে পরাজিত করবার পর ভাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে পান্ড্য রাজ্য অধিকার করেন । এরপর তিনি নাকি রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন । আলাউদ্দিন খলজি অবশ্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি সাম্রাজ্যভুক্ত না করে সেখানকার রাজাদের মৌখিক আনুগত্য ও করদানের প্রতিশ্রুতি নিয়েই করদ রাজ্যে পরিণত করেন । বিজেতা হিসাবে আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লির সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । স্যার উলসলি হেইগের মতে, তাঁর রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গেই সুলতানি সাম্রাজ্যবাদের সুত্রপাত হয় । তাঁর আমলেই প্রথম দক্ষিণ ভারতে সুলতানি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে । বিজেতা হিসাবে অনেকে তাঁকে আকবরের সঙ্গে তুলনা করেন । কিন্তু এই তুলনা অনেকাংশে অযৌতিক । আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যবাদ কোনো মহৎ আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না । বাহুবলের প্রাধান্যই ছিল এর একমাত্র ভিত্তি । আকবর সম্পর্কে এই কথা বলা চলে না । 

আলাউদ্দিন খলজির শাসনব্যবস্থা (Administrative Reforms) :

(১) শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন : সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন খলজি প্রশাসনিক সংস্কারের দিকেও মন দেন । তিনি ছিলেন স্বৈরতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক । কেন্দ্রীয় স্বৈরাচারী শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন । দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন । নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি উলেমাদেরও অগ্রাহ্য করতেন । কথা প্রসঙ্গে একবার তিনি মুঘুসউদ্দিনকে বলেছিলেন—"আমিই সেই সব নির্দেশ জারি করি, যা রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে এবং জনগণের মঙ্গল সাধন হয় । আমি জানি না কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ । রাষ্ট্রের পক্ষে যা মঙ্গলজনক আমি তাই করি ।" ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মতো তিনিও বলতে পারতেন, "রাষ্ট্র কী ? আমিই রাষ্ট্র ।" কেন্দ্রে নিজ কর্তৃত্বাধীনে একটি কঠোর অথচ সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা জারি করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য । শুধু উলেমাদের নয়, আমির-ওমরাহদেরও তিনি মাথা তুলতে দেন নি এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য এবং বিদ্রোহের মূল উৎপাটনের উদ্দেশ্যে তিনি তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট মেলামেশা ও খানাপিনা বন্ধ করে দেন । ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর আক্রমণ করে তিনি সমস্ত রকম ভাতা বন্ধ করে দেন । যে সব জায়গির দেওয়া হয়েছিল. সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে সরকারের খাস জমিতে পরিণত করা হয় । এইভাবে অভিজাতদের ওপর আক্রমণ করে তিনি বিদ্রোহের মূল উৎপাটন করেন ।

(২) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ (Market Regulation) : তিনি সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করেন এবং সৈনিকরা যাতে অল্প দামে জিনিস পত্র কিনতে পারেন তার জন্য বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করেন এবং রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, কারণ তিনি সৈনিকদের বেশি বেতন দিতেন না । ব্যবসায়ীরা যাতে মূল্যের বেশি টাকা দাবি না করে, তার জন্য তিনি কঠোর প্রসাশনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন । বিষয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলে 'শাহানা-ই-মান্ডি' ও 'দেওয়ান-ই-রিসালাত' -এর ওপর । আলাউদ্দিন খলজির লক্ষ্য ছিল সম্ভবত মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা ও ব্যবসায়ীরা যাতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারে, তার দিকে লক্ষ রাখা; কিন্তু তাই বলে ব্যবসায়ীরা একবারে বিনা লাভে বিক্রি করত এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই । আলাউদ্দিন খলজির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সফল হয়েছিল এবং এর দ্বারা সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও কিছুটা উপকৃত হয়েছিল । অবশ্য ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারায় মনঃক্ষুন্ন এবং অসন্তুষ্ট হয়েছিল । কিন্তু তাদের কিছু করার ছিল না । যতদিন আলাউদ্দিন খলজি জীবিত ছিলেন, ততদিন এইসব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোর ভাবে মানা হয় । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে ।

(৩) রাজস্ব অন্যান্য সংস্কার (Land Revenue and other Reforms) : অন্যদিকে দিল্লী সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম জমি জরিপ করে রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন । দেশে যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে সেদিকেও তিনি নজর দেন । অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বিধান দেওয়া হত । গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি দেশের সমস্ত খবরাখবর রাখতেন । জনগণের সক্রিয় সমর্থন, শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা তিনি হয়তো পান নি; কিন্তু এক সুদৃঢ় ও কঠোর শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে দিল্লি সুলতানিকে এক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন ।

মূল্যায়ন (Evaluation) : যুদ্ধ বিজেতা এবং প্রসাশক হিসাবে আলাউদ্দিন খলজি সুলতানি আমলে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দেন । অর্থনৈতিক সংস্কারের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে আলাউদ্দিন ছিলেন মধ্যযুগে ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক, যিনি—

(১) জমি জরিপ করিয়েছিলেন ,

(২) জায়গির দান বা ভূমিদান প্রথার অবলুপ্তি ঘটিয়েছিলেন ।

(৩) উচ্চ হারে রাজস্ব ও কর ধার্য করেছিলেন

(৪) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন ।

কিন্তু প্রজাপালন এবং জনকল্যাণ যদি কোনো রাষ্ট্রনায়কের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাটি হয়, তাহলে আলাউদ্দিন খলজিকে সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা যায় না ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ভারতের কৃষি নির্ভর শিল্প

মুঘল আমলে গ্রামীন অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প বা কুঠির শিল্প । কুঠির শিল্পকে দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে । প্রথমত, কৃষিনির্ভর শিল্প এবং দ্বিতীয়ত অকৃষি শিল্প । কৃষিনির্ভর শিল্পের মধ্যে পড়বে শর্করা শিল্প, তৈল, তামাক, নীল, মদ প্রভৃতি শিল্প । ...

সুলতানি ও মুঘল আমলের চিত্রকলা

একটি সময় ছিল যখন মনে করা হত সুলতানি আমলে চিত্রকলার কোনো চর্চা হত না । ইসলামে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ ছিল । বর্তমানে এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে । আসলে ভারতে ইসলামের আর্বিভাবের ফলে যে সমন্বয়ী প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়েছিল, তা ভারতের সংস্কৃতিকে গভীরভাবে ...

মুঘল যুগের স্থাপত্য

স্থাপত্য ও চিত্রকলার ইতিহাসে মুঘল যুগের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । নির্মাতা হিসাবে মুঘল সম্রাটদের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া । এই যুগের স্থাপত্য ভারতীয় ও পারস্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল । মুঘল স্থাপত্যরীতির সুচনা হয় আকবরের সময়ে ...

সুলতানি যুগের স্থাপত্য

দিল্লির কুতুবমিনার (Qutb Minar) হল এয়োদশ শতকের মুসলিম স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন । সুফি সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল । কুতুবমিনারের নির্মাণ কার্য শুরু করেন কুতুবউদ্দিন আইবক এবং সম্পূর্ণ হয় ইলতুৎমিসের আমলে । ...

প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরীতি ও মুসলিম শিল্পরীতির সংমিশ্রণ

প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরীতি ও মুসলিম শিল্পরীতির সংমিশ্রণ :

ফার্গুসনের মতে, সুলতানি স্থাপত্যের প্রকৃতি ছিল ইন্দো-স্যারাসিনিক (Indo-Saracenic) বা পাঠান । আবার হ্যাভেলের মতে, এই শিল্পরীতির ‘দেহ ও আত্মা’ ছিল ভারতীয় । আসলে সুলতানি যুগের স্থাপত্য প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরী