ইউরোপীয় ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 11/02/2014 - 19:59

ইউরোপীয় ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি (European Capitalism and Colonial Economy) :

ভারত ইতিহাসে ইংরেজ শাসনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার । কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মানদণ্ড অচিরেই রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল । আগে যেসব বহিরাগত জাতি ভারতে এসেছিল, তাদের সঙ্গে ইংরেজদের অনেক তফাৎ । আগেকার বহিরাগত মানুষ ভারতকেই মাতৃভূমিরূপে কালক্রমে বরণ করে নিয়েছিল । তাদের মাতৃভূমির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না । ইংরেজরা ভারতকে কোনো দিনই স্বদেশ বলে মনে করে নি । মাতৃভূমি ইংল্যান্ডের সঙ্গে তাদের ছিল নাড়ির টান । মাতৃভূমির স্বার্থে ভারতকে শোষণ করাই ছিল তাদের নীতি । ধনতন্ত্রের বিকাশ তাদের মাতৃভূমির দিকে আকৃষ্ট করেছিল এবং কালক্রমে ভারত ঔপনিবেশিক অর্থনীতির শিকার হয়েছিল ।  

ধনতন্ত্র বলতে কি বোঝায় (Capitalism) : ‘ধনতন্ত্র’ বলতে কি বোঝায়, তা এক কথায় বলা কঠিন । বস্তুত, বিভিন্ন পণ্ডিত ধনতন্ত্রের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন । ধনতন্ত্রের একটা সাদামাটা সংজ্ঞা হল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা দাঁড়িয়ে আছে পুঁজির উপর । এই সংজ্ঞা নির্ভুল, কিন্তু পর্যাপ্ত নয় । আবার এও বলা হয় ধনতন্ত্র হল এমন একটি উৎপাদন প্রক্রিয়া, যার প্রধান লক্ষ্য হল মুনাফা । এই সংজ্ঞাও ঠিক, কিন্তু এতেও ধনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপ ধরা পড়ে না । মনে রাখা দরকার ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও উৎপাদন পদ্ধতিতে পুঁজির ব্যবহার হত এবং উৎপাদনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুনাফা । উৎপাদন, ব্যবসাবাণিজ্য এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ধনতন্ত্রের আগেও ছিল । আসলে ধনতন্ত্রের পরিধি অনেক ব্যাপক । ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় এক অথবা একাধিক ধনী ব্যক্তি একটি কোম্পানি গঠন করে উৎপাদন অথবা ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকে । পর্যাপ্ত পুঁজি ও সম্পদের মালিক এই সব মানুষ নিজেরাই কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমও ক্রয় করে । এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মুল লক্ষ্য ব্যক্তিগত ভোগ নয়, মুনাফা অর্জন । ধনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য দুই শ্রেণির মেরুকরণ— শোষিত শ্রমিক শ্রেণি এবং শোষক পুঁজিপতি মালিক শ্রেণি । ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকলেও বা তার রক্ত জল করা পরিশ্রমে মালিক মুনাফার পাহাড় গড়ে তুললেও তাদের কোনো সম্পত্তি থাকে না । তাদের একমাত্র সম্পত্তি দৈহিক শক্তি, যা বেচে তারা পায় মজুরি । এই মজুরিতে তাদের কায়ক্লেশে দিন চলে । ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমদান ছাড়া শ্রমিকদের আর কোন ভূমিকা নেই । মালিক শ্রমিককে যে পরিশ্রম বা মজুরি দেয়, তার খানিকটা সে ফেরত পায় । বাকি অংশটুকুও সে পায় মুনাফা হিসাবে । এইভাবে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোষণ চলে ।

ধনতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ (Origin and spread of Capitalism) : প্রাচীন গ্রীস ও রোমে ধনতন্ত্র প্রচলিত ছিল । কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ধনতন্ত্রের পতন ঘটে । আদি মধ্য যুগে ইউরোপের অর্থনীতিতে ধনতন্ত্রের প্রচলন ছিল না । তখন প্রতিটি সম্প্রদায় মোটের ওপর স্বয়ং সম্পূর্ণ ছিল এবং নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করে ভোগ করত । অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের লোভ ছিল না । পরবর্তী মধ্যযুগে ধনতন্ত্রের লক্ষণ দেখা গেলেও ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকেই আধুনিক ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটে । ব্যবসাবাণিজ্য ও ভৌগোলিক আবিষ্কার ধনতন্ত্রের সহায়ক ছিল । শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার চরম বিকাশ ঘটল । মানুষের শ্রমের বদলে যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হল । অল্প সময়ে ও অল্প খরচে একদিকে যেমন উৎপাদন বহু গুণ বৃদ্ধি পেল, তেমনই উদবৃত্ত দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য ঘরের বাহিরে বাজার খোঁজার প্রযোজন দেখা দিল । বড় বড় কারখানা গড়ে উঠল এবং পুঁজিপতি মালিক শ্রেণি সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলল । ইংল্যান্ডেই প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল ।

*****

Related Items

কুষাণ সাম্রাজ্য (Kushana Dynasty)

মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর যে সমস্ত বৈদেশিক জাতি ভারতে অনুপ্রবেশ করে ছিল, তাদের মধ্যে কুষাণরাই ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য । মৌর্যদের পর তারাই প্রথম একটি বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল । কুষাণদের ভারতে প্রবেশের ইতিহাস অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক । ...

মগধের উত্থান (Rise of Magadha)

পরপর চারটি শক্তিশালী রাজবংশের ধারবাহিক রাজত্ব মগধের উত্থান সম্ভব করেছিল। সেই চারটি রাজবংশ হল- (১) হর্ষঙ্ক বংশ, (২) শিশুনাগ বংশ, (৩) নন্দ বংশ ও (৪) মৌর্য বংশ। মগধের উত্থানের কারণ , মৌর্যবংশ, মৌর্য শাসনব্যবস্থা, অশোক, কলিঙ্গযুদ্ধ জয় ...

ষোড়শ মহাজনপদ (Sixteen Mahajanapadas)

খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারত ঐক্যবদ্ধ ছিল না । মূলত বৌদ্ধ ও জৈন শাস্ত্র থেকে জানতে পারা যায় যে, ওই সময় ভারত ষোলটি রাজ্য বা মহাজনপদে বিভক্ত ছিল । যথা—অঙ্গ (বর্তমান পূর্ব বিহারের মুঙ্গের ও ভাগলপুর), মগধ (বর্তমান দক্ষিণ বিহারের পাটনা, গয়া এবং সাহাবাদের কিছু অংশ), ...

রাজশক্তির উত্থান (Growth of kingship)

প্রথম দিকে আর্যরা ভরত, যদু, অনু, পুরু, সঞ্জয় প্রভৃতি বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। পশুচারণ ও কৃষিজমি অধিকার নিয়ে প্রায়ই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকত। তখনকার দিনে রাজারা ছিল যোদ্ধাদের নেতা । ঋক্‌বেদে দশ রাজার যুদ্ধ থেকে এই যুদ্ধ ...

আধুনিক যুগের ঐতিহাসিক উপাদান

আধুনিক যুগের ইতিহাস রচনার জন্য ঐতিহাসিক উপাদানের কোনো অভাব নেই । লেখ্যাগারে সঞ্চিত সরকারি নথিপত্র, বিভিন্ন বিদেশী, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাগজপত্র, সংবাদ পত্র ও সাময়িক পত্র, শাসক ও সরকারি কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের দিনপঞ্জী ...