১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল ? এই বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ কর ।

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 01/07/2022 - 22:49

প্রশ্ন:-  ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল ? এই বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ কর ।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সামরিক কারণে সিপাহিদের ক্ষোভ যখন ক্রমশ পূঞ্জীভূত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে এনফিল্ড রাইফেল (Enfield Rifle) নামে এক নতুন ধরনের রাইফেলের প্রবর্তন তাদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় । এনফিল্ড রাইফেলে যে কার্তুজ (Cartridge) ব্যবহার করা হত, তার খোলসটি দাঁতে কাটে রাইফেলে ভরতে হত । গুজব রটে যায় যে, এই কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে । ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোম্পানির সেনাবাহিনীর হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে ।

এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হলেও একে প্রধান কারণ বলা যায় না । কারণ চর্বি মাখান টোটাই যদি এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ হত, তাহলে টোটা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকারি নির্দেশ জারি করার পরেই এই বিদ্রোহের অবসান ঘটত । এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন সম্পর্কে জনৈক ঐতিহাসিকদের মত হল, সিপাহিদের চোখের সামনেই টোটাগুলো নষ্ট করে ফেলা হলেও সিপাহি বিদ্রোহ অবশ্যই ঘটত, কারণ, এই বিদ্রোহের মুলে ছিল ব্রিটিশ প্রশানের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণ তথা সিপাহিদের তীব্র অসন্তোষ । পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহিরা চর্বি মাখানো এই টোটাই ব্যবহার করেছিল ।

মহাবিদ্রোহ ব্যর্থতার কারণ : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত নানান ক্ষোভ ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয় । বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর সমর্থন, জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সহানুভূতি থাকা সত্বেও মহাবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার মূলে একাধিক কারণ ছিল, যেমন—

(১) পরিকল্পনার অভাব : বিদ্রোহের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় প্রথম থেকেই এর সাফল্য লাভের সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে । সিপাহি বা জনগণের নেতৃবর্গ কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরতে পারেন নি । বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ায় বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজ প্রশাসনের বিশেষ কোনো অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয়নি ।

(২) বিদ্রোহের সীমাবদ্ধতা : ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহ প্রসারিত হলেও, তা কিন্তু মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের বিহার, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্রোহের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না । ভারতের সমস্ত অঞ্চলে বিদ্রোহ না হওয়ায় কোম্পানি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে এসে তাদের অন্যত্র বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত করে ।

(৩) বিভিন্ন জাতি ও দেশীয় রাজাদের বিরোধিতা : ভারতের বিভিন্ন জাতি ও দেশীয় রাজারা বিদ্রোহের বিরোধিতা করে ব্রিটিশদের সমর্থন করেন । হায়দ্রাবাদের নিজাম, কাশ্মীরের মহারাজা, সিন্ধিয়া, পাতালিয়া ও গুর্খা বীর স্যার জঙ্গ বাহাদুর প্রভৃতি দেশীয় রাজা ও অসংখ্য ছোটো-বড়ো জমিদার বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিল ।

(৪) অযোগ্য নেতৃত্ব : এই বিদ্রোহের সর্বজনস্বীকৃত নেতা ছিলেন সম্রাট বাহাদুর শাহ । তাঁর অযোগ্য নেতৃত্বদানে এই বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।

(৫) সঠিক পদ্ধতির অভাব : মহাবিদ্রোহের সাফল্যের জন্য যে রণকৌশল গ্রহণ করা দরকার তা অনেক ক্ষেত্রেই নেতৃবর্গের অজানা ছিল । ত্রুটিপূর্ণ রণকৌশল এবং অযোগ্য সামরিক পদ্ধতির জন্য এই বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।

*****

Comments

Related Items

সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা (Early Stages of Collective Action) : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় । এই যুদ্ধের একশো বছর পর ১

পাবনার কৃষকবিদ্রোহ (১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে)

পাবনার কৃষকবিদ্রোহ (Peasants' Revolt in Pabna)  :- ১৯৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল্ বিদ্রোহের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায় কৃষকদের ওপর জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কৃষকরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তা '

নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt)

নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt) : অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পে নীলের চাহিদা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেলে মুনাফালোভী ইংরেজরা দাদনের জালে আবদ্ধ করে ছলে, বলে, কৌশলে দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষকদের নীলচ

বাংলায় ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement in Bengal)

ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement):- ঊনিশ শতকে বাংলায় সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ফরাজি আন্দোলন । 'ফরাজি' শব্দটি আরবি শব্দ 'ফরজ' থেকে এসেছে । ফরজ শব্দের অর্থ হল 'আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত বাধ্যতামূলক কর্তব্য' । ইসলাম ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে হা

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement in Bengal)

ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement) : ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ হল ‘নবজাগরণ’ । আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন । ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরি