১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের কারণ

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 05/15/2013 - 16:36

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের কারণ (Cause of the Revolt of 1857)

মহাবিদ্রোহের কারণগুলি পর্যালোচনা করলে কারণগুলিকে মোটামুটি কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় । যথা— (ক) অর্থনৈতিক কারণ, (খ) সামাজিক কারণ, (গ) রাজনৈতিক কারণ, (ঘ) ধর্মীয় কারণ এবং (ঙ) সামরিক কারণ ।

(ক) অর্থনৈতিক কারণ:- ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক শোষণ চালানোই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রধান উদ্দেশ্য । এজন্য রাজত্বের সূচনা থেকেই তাঁরা দেশীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে তার ওপর ঔপনিবেশিক অর্থনীতি চাপিয়ে দেয় । এদেশের প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট করে, কুটির শিল্পগুলি ধ্বংস করে এবং দেশের যাবতীয় মূলধন ও সম্পদ হস্তগত করে এদেশের অর্থনীতির ওপর তারা একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে । দেশীয় ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এবং কুটির শিল্পগুলি ধ্বংস হওয়ার ফলে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে । দেশে বেকারি ও দারিদ্র বৃদ্ধি পায় । প্রজাসাধারণ কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে । কোম্পানির ভ্রান্ত নীতির ফলে একদিকে যেমন জমিদার ও মহাজন শ্রেণির উদ্ভব হয়, তেমনি অন্যদিকে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । কোম্পানির কর্মচারী এবং জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । ইতস্তত সংঘটিত প্রজা বিদ্রোহ বা কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটার পর সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে তার সর্বাত্মক প্রকাশ ঘটে ।

(খ) সামাজিক কারণ:- কোম্পানি রাজত্বের সূচনায় ইংরেজ শাসকবর্গ এদেশের সংস্কার কার্যে তেমন আগ্রহ দেখায় নি । কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে প্রগতিশীল ভারতবাসীর আগ্রহের আতিশয্যে ব্রিটিশ শাসকবর্গ সামাজিক কুপ্রথা এবং কুসংস্কারের অবসানকল্পে একের পর এক বিধি প্রণয়ন করতে থাকেন । সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তি, বিধবাবিবাহ প্রচলন, স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন, বাল্যবিবাহ নিবারণ প্রভৃতি ব্যবস্থা রক্ষণশীল হিন্দুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে । পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয় । এতে রক্ষনশীল ভারতীয়দের মনে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে সন্দেহ জাগে । তাঁদের ধারণা হয়, সমগ্র ভারতবর্ষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য ইংরেজগণ পরিকল্পিত উপায়ে তোড়জোড় শুরু করছিল । তদুপরি সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশের অবজ্ঞা এবং উপেক্ষা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয় । ভারতীয়দের সেই বিরূপ মনোভাব সিপাহি বিদ্রোহে পরোক্ষ ইন্ধন জোগায় ।   

(গ) রাজনৈতিক কারণ:- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী শাসকবর্গ যেভাবে একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলি গ্রাস করতে থাকে এবং রাজবংশের উচ্ছেদ করতে থাকে, তাতে দেশীয় রাজন্যবর্গ এবং তাদের কর্মচারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন । দুচার জন বাদে ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে লর্ড ডালহৌসি পর্যন্ত সকলেই সমস্ত প্রকার রীতিনীতি ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় রাজ্যগুলি অধিকার করেন । লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগের ফলে বহু রাজবংশের উচ্ছেদ হয় । মোগল বাদশাহের অপসারণ মুসলিমদের মনে দারুন আঘাত হানে । পেশোয়া নানা সাহেবের বৃত্তি বন্ধ করে ইংরেজগণ মারাঠাদের উত্তেজিত করে তোলেন । ফলে ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত রাজন্যবর্গের সঙ্গে এইসব অসন্তুষ্ট মানুষ হাত মেলালে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে । 

(ঘ) ধর্মীয় কারণ:- ভারতের খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ সামগ্রিকভাবে রক্ষণশীল ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয় । তাঁদের প্রগতিবাদী কার্যকলাপ মানুষের ধর্মবিশ্বাসে প্রচন্ড আঘাত হানে । মুসলিমগণ যাঁরা দীর্ঘকাল রাজ্যশাসনের দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা অপসারিত হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ও ব্রিটিশের প্রতি চাপা অসন্তোষ পোষণ করতে থাকেন । তাঁদের ক্ষমতাচ্যুতি এবং দুরাবস্থার জন্য তাঁরা ব্রিটিশকে দায়ী করেন । তাঁদের মধ্যেও বিদ্রোহের আগুন ধুমায়িত হয় । ওয়াহাবি আন্দোলনের মাধ্যমে সেই বিদ্রোহবহ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছিল । এই ঘটনা ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহে পরোক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছিল । 

(ঙ) সামরিক কারণ:- সেনাবিভাগে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বেতন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতের সৈন্যদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয় । সিন্ধু ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত সেনাদলকে বিশেষ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ভারতীয় সেনাগণ তা থেকে বঞ্চিত হতেন । তাঁদের ধর্ম বিশ্বাসকে মর্যাদা না দিয়ে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁদের যত্রতত্র বদলি ও নিয়োগের ব্যবস্থা করেন । জাত ও ধর্ম হারাবার ভয়ে সিপাহিগণ কালাপানি পার হয়ে ব্রহ্মদেশ বা অন্যত্র যেতে অস্বীকৃত হন । অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যখন তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত তখনই লর্ড ক্যানিং -এর প্রবর্তিত সামরিক নিয়োগ বিধি অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয় । এই বিধি বলে ভারতীয় সিপাহিদের যেকোনো কাজ করতেও বাধ্য করা হয়েছিল । এই পরিস্থিতিতে ১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ডের জয়লাভ সত্ত্বেও ব্রিটিশ সামরিক বিভাগের দুর্বলতা ভারতীয় সেনাদের উৎসাহিত করে তোলে । তাঁদের ধারণা হয়, ভারতে অনুরূপ ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারলে সেই অভ্যুত্থান দমন করা ইংরেজ বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না । ফলে তাঁরা তলে তলে প্রস্তুত হতে থাকেন । অন্য একটি বদ্ধমূল ধারণা এক্ষেত্রে কাজ করেছিল, যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন একশো বছর স্থায়ী হবে । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সেই শাসনেরই শতবর্ষ পূর্তি বৎসর । অতএব সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যেও ভারতীয় সিপাহিগণ তৎপর হন ।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ:- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সামরিক কারণে সিপাহিদের ক্ষোভ যখন ক্রমশ পূঞ্জীভূত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে এনফিল্ড রাইফেল (Enfield Rifle) নামে এক নতুন ধরনের রাইফেলের প্রবর্তন তাদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় । এনফিল্ড রাইফেলে যে কার্তুজ (Cartridge) ব্যবহার করা হত, তার খোলসটি দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত । গুজব রটে যায় যে, এই কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে । ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোম্পানির সেনাবাহিনীর হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে । এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হলেও একে প্রধান কারণ বলা যায় না, কারণ, চর্বি মাখানো টোটাই যদি এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ হত, তাহলে টোটা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকারি নির্দেশ জারি করার পরেই এই বিদ্রোহের অবসান ঘটত । এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন সম্পর্কে জনৈক ঐতিহাসিকদের মত হল, সিপাহিদের চোখের সামনেই টোটাগুলো নষ্ট করে ফেলা হলেও সিপাহি বিদ্রোহ অবশ্যই ঘটত, কারণ, এই বিদ্রোহের মুলে ছিল ব্রিটিশপ্রশানের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণ তথা সিপাহিদের তীব্র অসন্তোষ । পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহিরা চর্বি মাখানো এই টোটাই ব্যবহার করেছিল ।

******

Related Items

ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:-  ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো ।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান প্রকাশ করা হয় । ভারতীয় সংবিধানের চারটি উল্লেখযোগ্য প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—

মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

প্রশ্ন:-  মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:- ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

প্রশ্ন:-  ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রশ্ন:- আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?