সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 12/28/2020 - 17:59

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (Sanyasi-Fakir Rebellion):- ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে অবিভক্ত বাংলার ঢাকায় ১৭৬৩ থেকে ১৮০০  খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'গিরি' ও 'দাশনামী' সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী ও 'মাদারী' সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে যে কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তা 'সন্ন্যাসী-ফকির' বিদ্রোহ নামে পরিচিত । বাংলায় কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় । কৃষিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরদের কৃষিকাজের ওপর ব্রিটিশ সরকার ও জমিদাররা ভূমিরাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয় । ভূমিরাজস্ব ছাড়াও তাদের ওপর বিভিন্ন রকম কর আরোপ করা হয় । সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে অনেকেই রেশম বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । তাদের থেকে কোম্পানির কর্মচারীরা জোর করে কাঁচা রেশম ও রেশম পণ্য ছিনিয়ে নিত । সন্ন্যাসীরা মাঝেমধ্যে দল বেঁধে তীর্থস্থানে বের হত । ব্রিটিশ সরকার সন্নাসী-ফকিরদের তীর্থযাত্রার ওপর তীর্থকর চাপায় এবং ফকিরদের পিরস্থান বা দরগায় যাওয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করে তাদের ধর্মাচরণে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে । কোম্পানির কর্মচারীরা ও জমিদাররা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর নানাভাবে শোষণ ও রাজস্ব আদায়ের জন্য উৎপীড়ন চালাত । এই সব অসন্তোষকে কেন্দ্র করে অত্যাচারিত সন্ন্যাসী ও ফকিররা কোণঠাসা হয়ে পড়লে তারা বিদ্রোহের পথে যায় ।

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সূচনা হয় । ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বাংলা ও বিহারের দরিদ্র কৃষকেরা অন্ন ও বস্ত্রের জন্য সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ধ্বজা তোলেন । বিদ্রোহের আগুন ক্রমশঃ রাজশাহি, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কোচবিহার, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে । উত্তরবঙ্গের 'মাদারি' সম্প্রদায়ের ফকির এবং পূর্ববঙ্গ ও 'ময়মনসিংহের' 'গিরি' ও দাশনামী,  মারাঠা সম্প্রদায়ভুক্ত 'গোঁসাই' এবং শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত নাগা সন্ন্যাসীরা, ভোজপুরি রাও প্রমূখ এই বিদ্রোহে যোগ দেয় । পরে ক্ষমতাচ্যুত জমিদার, ছাঁটাই হওয়া সৈনিক ও বিতাড়িত কৃষক এ বিদ্রোহে যোগ দেয় । এই বিদ্রোহের পটভূমিকায় সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'আনন্দমঠ'  উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন । এই বিদ্রোহের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্য ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, কৃপানাথ, মুশা শাহ, মজনু শাহ, পরাগল শাহ, চিরাগ আলি শাহ, অনুপ নারায়ণ, নুরুল মহম্মদ, পীতাম্বর শ্রীনিবাস প্রমুখ অন্যতম ।

বিদ্রোহীরা প্রথমে ঢাকার ইংরেজ কুঠি ও পরে রাজশাহির রামপুর কুঠির ওপর আঘাত হানে । পূর্ণিয়াতে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ বাধে । ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রংপুরের যুদ্ধে বিদ্রোহীরা ব্রিটিশবাহিনীকে পরাজিত করে ও ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপ্টেন টমাসকে হত্যা করে । ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীদের আক্রমণে ক্যাপটেন এডওয়ার্ডস নিহত হন ও তার বাহিনী বিধ্বস্ত হয় । বিদ্রোহীরা প্রথমদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুটা সাফল্য পেলেও পরবর্তীকালে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় । ব্রিটিশবাহিনী নিষ্ঠুর দমননীতির দ্বারা বিদ্রোহের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয় ও শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিদ্রোহ থেমে যায় ।  

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল; প্রথমত, এই বিদ্রোহে হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম ফকিররা একযোগে অংশ নেয় । দ্বিতীয়ত, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় থেকেই নেতৃবর্গ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় । তৃতীয়ত, এই বিদ্রোহে কৃষিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরদের সঙ্গে সাধারণ কৃষক ও মোগল বাহিনীর কর্মচ্যুত সেনারা যোগ দেয় ।

সমকালীন বিভিন্ন তথ্য ও সূত্র থেকে জানা যায় যে, এইসব বিদ্রোহের কারণ ছিল-

(ক) বাংলা ও বিহারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতে করতে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকে কৃষকে পরিণত হয় । ইংরেজরা তাঁদের শোষণপীড়ন করেছিল ।

(খ) বছরের বিশেষ সময়ে এই সন্ন্যাসী ফকির কৃষকরা তীর্থে যেত । কিন্তু ইংরেজরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তাদের উপর তীর্থকর বসালে তারা ক্ষুব্দ হয়েছিল ।

(গ) ১১৭৬ সালের মন্বন্তরের সময় ইংরেজদের পৈশাচিক শোষণ ও অত্যাচারের দৃশ্য দেখে বিদ্রোহীরা ইংরেজ, মহাজন ও কিছু জমিদারদের উপর আস্থা হারায় ।

(ঘ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধার্য করা অত্যধিক রাজস্ব, জমি থেকে ইচ্ছামতো কৃষক উচ্ছেদ প্রভৃতি কারণে বাংলা-বিহারের কৃষকরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় ।

(ঙ) রাজস্ব আদায়ের নামে সার্বিক লুন্ঠন ও কোম্পানির লোকেদের নির্দয় অত্যাচার বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয় । প্রথমে কোম্পানির কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও মহাজনদের বাড়ি আক্রমণ করে । ১৭৬৩ -১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্রোহের আগুন বেশি প্রজ্বলিত থাকে, রাজশাহির রামপুর ও বোয়ালিয়ার কুঠি এবং ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছাড়িয়ে পড়ে ।

ব্যর্থতার কারণ:

১) সুযোগ্য নেতৃত্ব ও নেতাদের অভিজ্ঞতার অভাব এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা,

২) সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা,

৩) আদর্শহীনতা এবং সাম্প্রদায়িক অনৈক্য,  

৪) উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্রের অভাব প্রভৃতি কারণে এই চার দশক ধরে চলতে থাকা সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ।

প্রকৃতিগত বিচারে এই বিদ্রোহকে ব্রিটিশবিরোধী কৃষক সংগ্রাম বলা হয় । এই বিদ্রোহকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা হলেও উইলিয়াম হান্টার সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন । এটি ছিল পুরো দস্তুর ইংরেজ সরকার বিরোধী কৃষকদের বিদ্রোহ । যদিও লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস একে 'হিন্দুস্থানের যাযাবর' ও 'পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব' বলে চিহ্নিত করেছেন । সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীগণ ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার যে ব্রত গ্রহণ করেন তা পরবর্তীকালে বিদ্রোহীদের উদ্বুদ্ধ করে ।

***

Comments

Related Items

দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক

ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় জুড়ে সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষ উপেক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত । সমাজের তথাকথিত ওপর তলার উচ্চবর্ণ ও উচ্চবর্গের শিক্ষিত মানুষ রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির সবকিছুর হাল ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের করায়ত্ত করে রাখত । নিচু তলার মানুষ ভীত, ...

বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ

বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ(Development of Dalit Politics and Movements in Twentieth Century India):-

বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী যে জাতীয় আন্দোলনগুলি সংঘটিত হয় তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দ

বীণা দাস (Bina Das)

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাংলার বিপ্লবী বীণা দাস । তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে আগস্ট নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল চট্টগ্রামে । তাঁর পিতার নাম বেণী মাধব দাস ও মাতার নাম সরলা দাস ...

মাস্টারদা সূর্যসেন (Surya Sen)

ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেন যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত । তাঁর ডাকনাম ছিল কালু । সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম রাজমনি সেন এবং মায়ের নাম শশীবালা সেন ...

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (Bengal Volunteers)

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (Bengal Volunteers):-

গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ডাকা অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পরে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' সংগঠনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয়