লবণ সত্যাগ্রহ (Salt Satyagraha) :
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ ৭৮ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে গান্ধিজি গুজরাটের সবরমতী আশ্রম থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত ডান্ডি অভিমুখে তাঁর ঐতিহাসিক পদযাত্রা শুরু করেন । এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গান্ধিজির প্রায় পঁচিশ দিন সময় লেগেছিল । সত্যাগ্রহীরা ৫ই এপ্রিল ডান্ডিতে উপনীত হন । এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক পদযাত্রা 'ডান্ডি মার্চ' (Dandi March) নামে পরিচিত । পথ পরিক্রমাকালে জনসাধারণ গান্ধিজি এবং তাঁর অনুগামী সত্যাগ্রহীদের বিপুলভাবে অভিনন্দিত করেন । অনেকে সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাঁদের পদযাত্রাকে উৎসাহিত করেন । ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি ছবিসহ এই পদযাত্রার বিবরণ প্রকাশ করলে সারা দেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার হয় । জনগন অধীর আগ্রহে আসন্ন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন । একদিন উপবাস এবং প্রার্থনার পর ৬ই এপ্রিল গান্ধিজি সমুদ্র স্নানের পর সমুদ্রতীরে আরব সাগরের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করে লবণ আইন ভঙ্গ করেন । এই সঙ্গে দেশজুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় । সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এই আন্দোলন গুজরাট থেকে ক্রমশ ভারতের সর্বত্র বিশেষত বোম্বাই, মাদ্রাজ, বিহার, বাংলা, ওড়িশা, আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মালাবার প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে । মেদিনীপুরের কাঁথি, তমলুক, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহিষবাথান, ডায়মন্ডহারবার, কালিকাপুর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক ভাবে লবণ তৈরি শুরু হয় । যে সকল স্থানে প্রাকৃতিক পরিবেশে লবণ প্রস্তুত সম্ভব নয়, সেসব স্থানে বিদেশি দ্রব্য বর্জন, করদান বন্ধ আন্দোলন, বিদেশি পণ্যের সরকারি দোকানগুলির সামনে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণবিক্ষোভ প্রদর্শন প্রভৃতি আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি রূপে ঘোষিত হল । খান আবদুল গফফর খান, সরোজিনী নাইডু, বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী, সরলা দেবী, লীনা নাগ, স্বরূপরানি নেহরু, কমলা নেহরু প্রমুখ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন । হাজার হাজার স্ত্রীলোক এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে । এক দিল্লিতেই প্রায় ১৬০০ মহিলা আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন । বোম্বাইয়ের ধারসানা এবং ওয়ালডা নামক স্থান দুটিতে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল । গুজরাটের প্রায় আড়াই হাজার স্বেচ্ছাসেবক ধারসানার লবণ ভান্ডার আক্রমণ করলে পুলিশ লাঠি চালিয়ে তাঁদের হটিয়ে দেয় । পুলিশের লাঠি চালনায় তিনশোর মতো স্বেচ্ছাসেবক এবং সরোজিনী নাইডু সহ বহু নেতা আহত হয়ে গ্রেফতার বরণ করেন । ওয়ালডার লবণ ভান্ডারে আক্রমণ করে সত্যাগ্রহীগণ কারাবরণ করেছিলেন । বাংলার ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত মহিষবাথান ও মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমায় আইন অমান্য আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করেছিল । কাঁথি মহকুমায় সত্যাগ্রহীরা সমুদ্রতীরে লবণ তৈরির সময় পুলিশের গুলিবর্ষণের শিকার হন । অন্যত্রও সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের অত্যাচার চরমে ওঠে । সত্যাগ্রহী ও নিরীহ দর্শকদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় । নির্বিচারে অসংখ্য নরনারীকে গ্রেফতার করা হয় । এর প্রতিবাদে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতায় এক মিছিল বার কারবার চেষ্টা করলে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হন । বাংলার মতো লাহোর, বিহারের ভাগলপুর, মুঙ্গের, সমস্তিপুর, পাটনা প্রভৃতি স্থানে আইন অমান্য আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করেছিল । দক্ষিণ ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিষদ (War Council) গঠিত হয় । এই পরিষদের পরিচালনায় মহারাষ্ট্র সমেত দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে আইন অমান্য আন্দোলন গণ আন্দোলনে পরিণত হয় ।
সরকারি দমন নীতি :
আইন অমান্য আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ নিলে এবং উগ্র আকার ধারণ করলে সরকার কড়া হাতে আন্দোলনকারীদের দমন করতে সচেষ্টা হন । আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে পুলিশের লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ, গ্রেফতার কোনো কিছুই বাদ যায় নি । বিদ্রোহ দমন করার জন্য কোথাও কোথাও সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয় । পুলিশ ও সেনার গুলিতে বহুসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারান, লক্ষাধিক সত্যাগ্রহী কারারুদ্ধ হন । সরকারি হিসাবমতো, প্রায় ৭৬,০০০ সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল । এসব সংবাদ যাতে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত না হয় তার জন্য 'প্রেস অর্ডিনান্স'-এর ধারা অনুসারে সংবাদপত্রের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ও প্রায় ৬৭টি জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের মধ্যে ৫৫টির প্রকাশনা সরকার বন্ধ করে দেয় । এসব সত্ত্বেও আন্দোলনকারীরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন । ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর দমননীতি আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে পারে নি ।
*****
- 7714 views