Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 01/31/2021 - 23:16

বারদৌলি সত্যাগ্রহ (Bardoli Satyagraha):-

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভয়ংকর বন্যায় বারদৌলি অঞ্চলে প্রচুর ফসল নষ্ট হলে সেখানকার কৃষকরা দুর্ভিক্ষের শিকার হয় । এই পরিস্থিতিতে সরকারি রাজস্ব বিভাগের নির্দেশে বারদৌলিতে ৩০ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয় । নবজীবন ও ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় এই রাজস্ব বৃদ্ধি অনুচিত বলে এক রিপোর্টে প্রকাশিত হয় । এই রাজস্ববৃদ্ধি কমে ২১.৯৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও তার প্রতিবাদে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি তালুকে খাজনা বন্ধের লক্ষ্যে কৃষকরা শক্তিশালী আন্দোলন শুরু করে । এই কৃষক আন্দোলন 'বারদৌলি সত্যাগ্রহ' নামে পরিচিত । কল্যাণজি মেহতা ও কুনবেরজি মেহতা নামে দুই ভাই ও দয়ালজি দেশাই নামে একজন স্থানীয় নেতা কৃষকদের মধ্যে অসহযোগের আদর্শ ছড়িয়ে দেন ও স্থানীয় স্কুলছাত্রদের দেশপ্রেমের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে তোলেন । বিদেশি বস্ত্র বয়কট ও মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন । নানাবিধ সমাজ সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন । পতিদাররা বারদৌলি তালুকে অবস্থাপন্ন কৃষক ছিলেন । পতিদার জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কুনবি বারদৌলি তালুকের জমির মালিকানা ভোগ করতেন ও ঋণদাসদের দিয়ে এই পতিদাররা তাদের জমি চাষ করাতেন । এই ঋণদাসরা 'কালিপরাজ' অর্থাৎ 'কালো মানুষ' নামে পরিচিত ছিল । আর এখানকার উচ্চবর্ণের মানুষরা 'উজালিপরাজ' অর্থাৎ 'সাদা মানুষ' নামে পরিচিত ছিল । অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর উপজাতি কৃষক কালিপরাজরা বারদৌলি তালুকের মূল জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি ছিল । অনুন্নত এই সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্কুল স্থাপন করা হয় ও এদের অবস্থার উন্নতির জন্য ৬টি আশ্রম খোলা হয় ।

এইসব সেবামূলক এবং শিক্ষামূলক গঠন কাজে গান্ধিজি স্বয়ং উৎসাহ দিতেন এবং তিনি কালিপরাজ নাম বদলে নতুন নামকরণ করেন 'রানিপরাজ' অর্থাৎ অরণ্যের অধিবাসী । নরহরি পারেখ, জুগতরাম দাভে প্রমূখ বিশিষ্টগণ গান্ধিজির নির্দেশ মেনে এদের অবস্থার অনুসন্ধান চালালে কালিপরাজদের অসহায় অবস্থা প্রকাশিত হয় । ইতিমধ্যে তেলের দাম কমে যাওয়া সত্বেও ব্রিটিশ সরকার রাজস্বহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় । এই প্রেক্ষাপটে মেহতা ভাতৃদ্বয় বারদৌলি সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য গান্ধিবাদী কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেলকে অনুরোধ জানায় ।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বল্লভভাই প্যাটেল বারদৌলি তালুকে এসে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন ও খাজনা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে শপথ নিতে বলেন । কৃষকেরা গীতা ও কোরান ছুঁয়ে শপথ নেয় যে তারা সরকারকে অতিরিক্ত হারে খাজনা দেবে না । এর ফলে বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় । বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে কৃষকেরা দলে দলে কর বয়কট আন্দোলনে শামিল হয় । এই আন্দোলনে বল্লভভাই প্যাটেল মহিলাদেরও অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করেন । বারদৌলির কৃষক-রমণীরা বল্লভভাই প্যাটেলকে 'সর্দার' উপাধি দেন । বোম্বাই -এর অভিজাত পারসি মিঠুবেন প্যাটেল, মনিবেন প্যাটেল, ভক্তিবাঈ, সারদাবেন শাহ এবং সারদা মেহতা প্রমুখ নারীরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । আন্দোলনে নরহরি পারিখ, রবিশংকর ব্যাস, মোহনলাল পান্ডে প্রমুখ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে সহযোগিতা করেন । 

বোম্বাই -এর কাপড়ের কলের শ্রমিকরাও এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায় । আন্দোলনের সমর্থনে বোম্বাই বিধানসভার সদস্য কে এম মুনশি ও লালজি নারাণজি পদত্যাগ করেন । গান্ধিজিও বারদৌলিতে এসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন । শেষপর্যন্ত আন্দোলনের ব্যাপকতা লক্ষ করে ব্রিটিশ সরকার 'ব্রুমফিল্ড-ম্যাক্সওয়েল' -তদন্ত কমিটি গঠন করেন । কমিটির সুপারিশ মেনে বর্ধিত কর ৬.০৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় । বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলন সাফল্য লাভ করে ।

***

Comments

Related Items

সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় হিন্দুসমাজে নারীরা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকর হতেন । এই সব নির্যাতনের মধ্যে অন্যতম ছিল সতীদাহপ্রথা বা সহমরণ । এই প্রথা অনুযায়ী ঊনিশ শতকের সূচনালগ্নেও বাংলা তথা ভারতীয় হিন্দুসমাজে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় তার বিধবা...

উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্মসমাজ সমূহের উদ্যোগ

উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলার সমাজজীবনে বিভিন্ন ধরণের কুপ্রথা প্রচলিত ছিল । সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসীপ্রথা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, কৌলিন্য প্রথা, গঙ্গাজলে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি নানান অমানবিক কুপ্রথা ও মানুষের মনে অন্ধবিশ্বাস বাংলার সমাজজীবনকে জর্জরিত

উনিশ শতকের বাংলা — সমাজ সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

উনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলায় ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সময় বাংলার সমাজজীবনে চরম দুর্দিন চলছিল । হিন্দুসমাজে তখন ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তারাই সমাজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন । হিন্দুসমাজে প্রকট জাতিভেদ প্রথা চালু ছিল । হিন্দুসমাজ ছিল

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষার বিকাশ

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড শিক্ষানীতির ওপর একটি পরিকল্পনা পেশ করেন যা 'উডের ডেসপ্যাচ' নামে পরিচিত । এই শিক্ষা পরিকল্পনায় যে সমস্ত সুপারিশগুলি করা হয় সেগুলির মধ্যে অন্যতম

মধুসূদন গুপ্ত

ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা প্রসারের সঙ্গে মধুসূদন গুপ্তের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত । তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ডেভিড হেয়ারের 'পটলডাঙ্গা স্কুলে' প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নিয়ে পড়াশুনা ...