নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বা ইয়ং বেঙ্গল

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 12/05/2020 - 22:03

ঊনিশ শতকে যেসব আন্দোলন বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেগুলির মধ্যে 'নব্যবঙ্গ আন্দোলন' বা 'ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ঊনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও -র নেতৃত্বে একদল যুবক যুক্তিবাদ, মু্ক্তচিন্তা, মানসিক স্বাধীনতা, সাহস ও সততার মাধ্যমে হিন্দুসমাজ ও ধর্ম সংস্কারের কাজে বিশেষ খ্যাতিলাভ করে । ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামী যুবকগোষ্ঠী 'নব্য বঙ্গ' বা 'ইয়ং বেঙ্গল' নামে পরিচিত । ডিরোজিও মাত্র ১৭ বছর বয়সে হিন্দু কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন । ডিরোজিও নিজে হেসপেরাস, ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট, ইন্ডিয়া গেজেট, ক্যালকাটা ম্যাগাজিন, ইন্ডিয়ান ম্যাগাজিন, বেঙ্গল অ্যানুয়াল, ক্যালেইডোস্কোপ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা প্রকাশ করেন । হিন্দুধর্মের পোত্তলিকতা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' নামে একটি বিতর্কসভা প্রতিষ্ঠা করেন । এখানে তাঁরা সামাজিক কুসংস্কারগুলি সম্পর্কে স্বাধীন, খোলাখুলি আলোচনা ও বিতর্কে অংশ গ্রহণ করতেন । সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর তরফে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে 'পার্থেনন' পত্রিকা প্রকাশিত হয় । এই পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে দাবি জানানো হয় । ডিরোজিও -র অনুগামী গোষ্ঠী পার্থেনন পত্রিকা ছাড়াও এনকোয়ারার, জ্ঞানান্বেষণ, কুইল প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে নিজেদের ভাবনা-চিন্তা মেলে ধরেন । নব্যবঙ্গীয় গোষ্ঠীর আন্দোলন মূলত শহরের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । তাই অনিল শীল বলেছেন, "তাঁরা গজদন্ত মিনারে বাস করতেন" (They lived in ivory towers) । তবুও নব্যবঙ্গীয়দের আন্দোলন একেবারে ব্যর্থ হয়নি, তাঁরা ভারতীয় সমাজকে যুক্তিবাদের পথে পরিচালনায় সফল হয়েছিলেন । নব্যবঙ্গীয়রা যে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছিলেন তা পরবর্তীকালের সমাজ সংস্কারকদের প্রভাবিত করেছিল । কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্র ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র বসাক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, শিবচন্দ্র দেব, হরচন্দ্র ঘোষ, কাশীপ্রাসাদ ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ ডিরোজিওর অনুগামী তথা নব্যবঙ্গ (Young Bengal) গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন । নব্যবঙ্গদের আচরণ রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ মেনে নিতে পারেননি । তাঁরা তাদের সন্তানদের হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিতে থাকেন ও তাঁদের চাপে ডিরোজিওকে পদচ্যুত করা হয় । এর কিছুদিন পর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্রা ২৩ বছর বয়সে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর ডিরোজিও -র মৃত্যু হয় । ডিরোজিও -র মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা নব্যবঙ্গ আন্দোলন চালিয়ে যান এবং ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা 'সাধারণ জ্ঞান অর্জন সমিতি' প্রতিষ্ঠা করে মানুষদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেন ।        

****

Comments

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা