জাতি সংঘের ব্যর্থতা (Failure of the League of Nations)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 22:34

জাতিসংঘের ব্যর্থতা (Failure of the League of Nations) :

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান এবং সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে এপ্রিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ঘোষিত 'চৌদ্দ দফা' দাবির ভিত্তিতে লিগ অফ নেশনস বা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয় । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি উড্রো উইলসনের সভাপতিত্বে লিগ অফ নেশনস -এর প্রথম অধিবেশন বসে । প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বিশ্বসংস্থা শান্তিপূর্ণ উপায়ে কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিরোধ মিমাংসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । কিন্তু যেখানে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ জড়িত সেখানে জাতিসংঘ তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয় । তিরিশের দশকে জাপান যখন মাঞ্চুরিয়া দখল করতে উদ্যোগী হয়, অথবা ইটালি ও জার্মানি যখন সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের নেশায় মেতে উঠে তখন তাদের নিরস্ত করার সাধ্য জাতিসংঘের ছিল না । বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার যে আশা নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় । জাতি সংঘের ব্যর্থতার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে এবং ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয়, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ববাসী আরও একটি ভয়াবহ ও নৃশংস বিশ্ব যুদ্ধের সম্মুখীন হয় । জাতিসংঘের ব্যর্থতার পিছনে কতকগুলি কারণ নিহিত ছিল—

(১) জাতিসংঘ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী জাতিসমূহের প্রতিষ্ঠান, বিজিত দেশগুলির নয় । বিজয়ী দেশগুলি বিজিত দেশগুলির ওপর নিজেদের ইচ্ছামতো কতকগুলি অন্যায় সন্ধির শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, যেগুলি তখনকার মতো তারা মেনে নেয় । কিন্তু এজন্য প্রথম থেকেই তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল । পরে সুযোগ মতো তারা প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হয় । এজন্য বলা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সন্ধির শর্তাবলির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল ।

(২) মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চেষ্টাতে জাতিসংঘ স্থাপিত হলেও মার্কিন সেনেট তা অনুমোদন করে নি । ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল দেশ জাতিসংঘের বাইরে ছিল । ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হাতে জাতিসংঘের দায়িত্ব থাকলেও আমেরিকার অনুপস্থিতিতে তারা বিশ্ব উত্তেজনা প্রশমনে ব্যর্থ হয় ।

(৩) বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজেরাই জাতিসংঘের আরোপিত চুক্তিগুলি অমান্য করতে থাকে । হিটলার ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘন করে অস্ত্রসজ্জা, অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া জয়, রাইন অঞ্চলে জার্মান বাহিনী মোতায়েন প্রভৃতি জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন ।  জার্মানি ও ইটালির প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তোষণ নীতি অবলম্বন করলে ক্রমে হিটলার বেপরোয়া হয়ে ওঠে ও তাদের নিশ্চেষ্টতার সুযোগ নিয়ে হিটলার ধাপে ধাপে শক্তি সঞ্চয় করে জাতিসংঘের প্রতিই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় । বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথে সহায়ক কেলগ-ব্রিয়াঁ চুক্তি, যা সকল রাষ্ট্রের সম্মতিতে সম্পাদিত হয়েছিল তা সকলেই ভূলে গিয়ে পরস্পর অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে । জাতিসংঘের শর্তগুলি মান্য করতে কোনো সদস্য রাষ্ট্রই আন্তরিক ছিল না । ফলে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয় ।

(৪) জার্মানি, ইটালি, জাপান একের পর এক আগ্রাসী মনোভাব নিলে জাতিসংঘ তাদের নিরস্ত করতে ব্যর্থ হয় । জাপান চিনের মাঞ্চুরিয়া এবং ইটালি আবিসিনিয়া দখল করতে উদ্যোত হলে জাতিসংঘ তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয় । তখন উভয় দেশই জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে । এরপর জার্মানি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চেকোশ্লোভাকিয়া এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ড আক্রমণ করলে জাতিসংঘ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে । এটাও তার ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ।

(৫) জাতিসংঘের সাফল্যের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির ঐক্যমত্য ও পারস্পরিক সম্প্রীতির প্রয়োজন ছিল । কার্যত তা দেখা যায় নি । বহু শক্তিশালী রাষ্ট্র নিজেদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করতে লিগকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিল ।

(৬) ১৯২৯-৩০ -এর অর্থনৈতিক মন্দা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জটিলতা ও উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছিল । জাতিসংঘ তার কোনো সুরাহা করতে পারে নি । 

(৭) জাতিসংঘের সর্বাপেক্ষা বড়ো ত্রুটি এর কোনো নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল না । ফলে জাতিসংঘের নির্দেশ অমান্যকারী দেশগুলির বিরুদ্ধে এই বিশ্বসংস্থা কোনো ফলপ্রসু ব্যবস্থা নিতে পারে নি ।

এইসব কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে 'লিগ অফ নেশনস' -এর পতন হয় । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় । তবে 'লিগ অফ নেশনস' পৃথিবীতে বিশ্বশান্তির যে সর্বজনীন আবেদন তুলে ধরেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে আগামী দিনে তাই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (United Nation) ভিত্তি প্রস্তুত করেছিল । 

*****

Related Items

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Kashmir):-

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দু

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Hyderabad):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' -এ বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে ।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to the Accession of Princely State with India):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪)

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪) [Post-Colonial India : Second Half od the 20th Century (1947-1964)]:-

দীর্ঘদিনের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আত্মবলিদানের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন

হিন্দু জাতিভুক্ত নিম্নবর্গীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার উল্লেখযোগ্য দলিত হিন্দু সম্প্রদায় । নমঃশূদ্ররা হিন্দু জাতিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত । নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল । ...