Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 19:19

চুয়াড় বিদ্রোহ (Chuar movements)

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যেসব আদিবাসী কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল চুয়াড় বিদ্রোহ । এই বিদ্রোহ দুটি পর্বে সংঘটিত হয় । প্রথম পর্বের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে । বাংলার মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহলের অধিবাসীরা ছিল চুয়াড় উপজাতি । তথাকথিত সভ্য শ্রেণির মানুষের কাছে 'চুয়াড়' শব্দের অর্থ হল অসভ্য, বর্বর, বন্য । চুয়াড়রা সাধারণত কৃষিকাজ, পশুপাখি শিকার ও জঙ্গলমহলে উৎপাদিত বিভিন্ন জিনিস বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করত । চাষবাস ও পশুশিকারের সঙ্গে জড়িত থাকলেও যুদ্ধবিগ্রহ ছিল তাদের প্রধান পেশা । চুয়াড় সম্প্রদায়ের মানুষেরা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, সিংভূম, মানভূম ও ধলভূমের স্থানীয় জমিদারদের অধীনে রক্ষী বা পাইকের কাজ করত । পাইকের কাজ করার বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে তারা যে নিষ্কর জমি ভোগ করত তা 'পাইকান জমি' নামে পরিচিত ছিল । এরা সাধারণত প্রথাগত অস্ত্রশস্ত্র অর্থাৎ তিরধনুক, টাঙ্গি, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে যুদ্ধ করত ।

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে । দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি জঙ্গলমহল এলাকায় উচ্চ হারে রাজস্ব ধার্য করে । তার প্রতিবাদে চুয়াড় কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে । জমিদারদের সঙ্গে সহমত হয়ে কোম্পানি অধিক হারে ভূমিরাজস্বের বন্দোবস্ত করলে জমিদাররাও নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর উচ্চ হারে রাজস্ব চাপায় । এই অধিক রাজস্ব দিতে অপারগ কৃষক প্রজাদের জমি কেড়ে নিয়ে তা নতুন প্রজাদের দেওয়া হয় । তা ছাড়া নতুন ভূমিবন্দোবস্ত অনুযায়ী পাইকদের দখলে থাকা নিষ্কর জমি কেড়ে নেওয়া হয় । এই অবস্থায় চুয়াড়রা বিদ্রোহের পথে যেতে বাধ্য হয় । ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম কোম্পানির বিরুদ্ধে ধল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । চুয়াড়রাও এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভাবে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় । অবশেষে কোম্পানি জগন্নাথ সিংহের ভ্রাতুষ্পুত্রকে জমিদারি ফিরিয়ে দেয় । এরপর ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ধাদকার শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে চুয়াড়রা আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেও ব্যর্থ হয় ।

প্রথম পর্বের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও চুয়াড়দের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে । এই আগুন ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে চুয়াড়দের দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের সময় দাবানলের চেহারা নেয় । জঙ্গলমহল-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চুয়াড় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে । বাঁকুড়ার রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিং, মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি প্রমুখ বিদ্রোহীদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি জানান । বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন গোবর্ধন দিকপতি, মোহনলাল ও লাল সিং । বীরভূমের সীমান্তে লাল সিং -এর নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ জন কৃষক ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নেয় । দুর্জন সিং -এর নেতৃত্বে কমপক্ষে ৩০টি গ্রামের সর্দার ও পাইক সম্প্রদায় দলবদ্ধভাবে লুটপাট ও হত্যালীলা চালায় । রায়পুর, বাসুদেবপুর, বলরামপুর, তমলুক, রামগড়, শালবনি প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহীরা লড়াই শুরু করে । বিদ্রোহীদের চাপে ইংরেজ পুলিশ ও কর্মচারীরা বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র রায়পুর ছেড়ে পালিয়ে গেলেও শীঘ্রই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহী জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের পরাজিত করে । রানি শিরোমনিকে হত্যা ও দুর্জন সিংকে গ্রেপ্তার করা হয় । এর ফলে বিদ্রোহ থেকে যায় ।

বিদ্রোহের শেষে চুয়াড়দের কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্রিটিশ সরকার চুয়াড় অধ্যুষিত এলাকায় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায় । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে 'জঙ্গলমহল' নামে একটি বিশেষ জেলা গড়ে তোলা হয় । চুয়াড়দের একাংশকে বিশেষত পুলিশের কাজে নেওয়া হয় । পাইকদের নিষ্কর জমি ফেরত দেওয়া হয় । নতুন ব্যবস্থায় বলা হয় পাইকরা খুব কম হারে রাজস্ব দেবে এবং তাদের জমি কোনোভাবেই খাসজমি করে নেওয়া হবে না । চুয়াড় বিদ্রোহের প্রকৃতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ লিখেছেন—"চুয়াড়দের এই বিদ্রোহ ছিল নিম্নশ্রেণির লোকের স্বতঃস্ফুর্ত অথচ ব্যাপক এক বিদ্রোহ"।

বৈশিষ্ট্য:- চুয়াড় বিদ্রোহের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল —

(১) এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষক ।

(২) এই বিদ্রোহে নিম্নশ্রেণির লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল ।

(৩) চুয়াড় উপজাতির এই বিদ্রোহে প্রথম নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন জমিদার, যা ছিল সত্যিই অভিনব ।

*****

Related Items

গোরা (Gora)

গোরা (Gora) of Rabindranath Tagore :-

ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রচিত গোরা উপন্যাসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এই  উপন্যাসের কয়েকটি মুখ্য চরিত্র হল— গোরা, আনন্দময়

বর্তমান ভারত (Bartaman Bharat)

বর্তমান ভারত (Bartaman Bharat) :-

'বর্ত্তমান ভারত' স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি প্রবন্ধ । ১৮৯৭ সালে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ করেন । তারপর ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বাংলা মু

আনন্দমঠ (Anandamath)

আনন্দমঠ (Anandamath):-

ঊনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে যেসমস্ত ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর মধ্যে জাতী

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Expression of Nationalism in Literary Works and Paintings):-

ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা শুরু হয় ও ক্রমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে । স

হিন্দু মেলা (Hindu Mela)

হিন্দু মেলা (Hindu Mela) :-

ঊনিশ শতকে বাংলায় যেসমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল 'হিন্দুমেলা' । পণ্ডিত রাজনারায়ণ বসুর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চৈত্রসংক্রান্তির