গণতন্ত্রের বিপর্যয় (Collapse of Democracy)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 22:31

গণতন্ত্রের বিপর্যয় (Collapse of Democracy) :

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হিটলার চ্যান্সেলার হওয়ার পর থেকে ইউরোপে দ্রুত গতিতে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটতে থাকে । ঐতিহাসিক এরিখ হবসন এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছেন— ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বে ৩৫টির বেশি গণতান্ত্রিক সরকার ছিল । ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তা কমে ১৭টিতে দাঁড়ায় । এর কারণগুলি হল—

(১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের যে সব দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেই সব দেশগুলিতে উদ্ভুত মানুষের সমস্যাগুলির সমাধানে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যর্থ হয় বলে মানুষ ওই সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছিল । বিশেষত ইটালি ও জার্মানির গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক সরকার নিজ নিজ দেশের জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে নি । সেই অকর্মণ্যতার সুযোগ নিয়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনী এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইটালির ক্ষমতা দখল করেন । ইটালির রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল মুসোলিনীর অনুকূলে ক্ষমতা ত্যাগ করেন । ভিক্টর নামে রাজা হলেও মুসোলিনী প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হন ও ইটালিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় । একই ভাবে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত জার্মান প্রজাতন্ত্র সে দেশের বিচিত্র ও জটিল সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় হিটলার সেই সুযোগের সদব্যবহার করেন । হিটলার প্রথম থেকেই ভার্সাই সন্ধি চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন । হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং অপমানজনক সন্ধির শর্তাবলির বিরুদ্ধে উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করে তুলতে সমর্থ হন । তাঁর আত্মজীবনী 'মেইন ক্যাম্প' -এ বর্ণিত তাঁর রণনীতি জার্মানদের সামগ্রিকভাবে আকৃষ্ট করেছিল । এভাবে হিটলারের নেতৃত্বে নব জাগ্রত জাতীয়তাবোধে জাগ্রত জার্মানির অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটায় ।

(২) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কিছু দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাবে সেখানে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যায় নি ।

(৩) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠনে সমস্যা ছিল । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে 'পপুলার ফ্রন্ট' গঠনের আগে পর্যন্ত বারবার নির্বাচন জনিত রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল । জার্মানিতেও সংখ্যা গরিষ্ঠতার অভাবে 'ভাইমার প্রজাতন্ত্রের' বিপর্যয় নেমে এসেছিল ।

(৪) প্রাচ্যে জাপানের উত্থান ও সমরবাদ সন্নিহিত গণতান্ত্রিক দেশগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছিল । ঊনিশ শতকের তৃতীয় দশকে জাপান পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি এবং শিল্পবাণিজ্যে সমৃদ্ধ হয় । সেই সঙ্গে জাপান এক বিশিষ্ট সামরিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে । চিনের ওপর জাপানের সামরিক আগ্রাসনে জাপানের সাম্রাজ্য লিপ্সার প্রথম প্রকাশ ঘটে । চীন-জাপান যুদ্ধে জাপান জয়লাভ করে । ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপান জয়ী হয়ে মাঞ্চুরিয়া দখল করে । পোর্টসমাউথের সন্ধিতে জাপানের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় । এরপর জাপান কোরিয়া দখল করে । একের পর এক সামরিক সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে জাপান হিটলারের জার্মানির সঙ্গে এক নতুন শক্তিজোট গঠন করে গণতন্ত্রের বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করে ।

(৫) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কর্তৃক জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করেছিল ।

(৬) ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময় ইটালি ও জার্মানি জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করায় স্পেনে প্রজাতন্ত্রের পতন ও একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় ।

(৭) ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডে একনায়কতন্ত্র ও ডঃ সালজারের নেতৃত্বে পর্তুগালে একনায়কতন্ত্র সরকার গঠিত হয়েছিল । হাঙ্গেরিতে গণতন্ত্র পাঁচ মাস স্থায়ী হলেও অস্ট্রিয়াতে আরও কিছুদিন টিকে থাকার পরও পূর্ব-মধ্য ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিতে গণতন্ত্রে ধ্বস নামে ।

(৮) জাতিসংঘের ব্যর্থতা গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষজনের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি করেছিল ।

সংক্ষেপে বলা যেতে পারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে (ক) গণতন্ত্রের মড়ক,  (খ) নবপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির দুর্বলতা, (গ) গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাব,  (ঘ) দুরদর্শী জনপ্রিয় রাষ্ট্র নায়কের অভাব, (ঙ) অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত, (চ) জাতিসংঘের ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে ইউরোপ গণতন্ত্রের পতন ঘটে ।

*****

Related Items

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন (Women and the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড প্রভৃতির প্রতিবাদে গান্ধিজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দ

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন (Women and the Anti-partition Movement):-

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনকালে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে বাংলা তথা ভারতে এ

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Women's Movements in the Twentieth Century):-

বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্ব

মানবেন্দ্রনাথ রায় ও ভারতের বামপন্থী আন্দোলন

মানবেন্দ্রনাথ রায় ও ভারতের বামপন্থী আন্দোলন(M.N.Roy and the Left Movement in India):-

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আসল নাম হল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য । বিপ্লবী কাজ করতে গিয়ে তিনি অসংখ্য ছদ্মনাম গ্রহণ করেন, যেমন— মি. মার্টিন, হরি সিং, ডা. মাহমুদ, মি.

বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণ

বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণ (Participation of the Left in the Anti-Colonial Movement in India):-

রুশ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি, মহম্মদ আলি সহ ২৪ জন প্রবাসী ভারতীয়