Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 01/05/2021 - 16:35

আনন্দমঠ (Anandamath):-

ঊনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে যেসমস্ত ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলেন । এজন্য উপন্যাসটি 'স্বদেশপ্রেমের গীতা' নামে পরিচিত । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসটি ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ও ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'আনন্দমঠ' উপন্যাসটি রচনা করেন । ইতিহাসের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসটি স্বদেশপ্রেমের এক জ্বলন্ত নিদর্শন । এই উপন্যাসে সন্তান দলের মুখ দিয়ে উচ্চারিত বন্দে মাতরম ধ্বনি বাংলা তথা সমগ্র ভারতবাসীকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আদর্শে উদ্দীপ্ত করে । উপন্যাসটির কয়েকটি বিশিষ্ট চরিত্র হল ভবানন্দ, জীবনানন্দ, কল্যাণী, বীণা, সত্যানন্দ, মহেন্দ্র প্রমুখ ।

এই উপন্যাসটির কাহিনিতে দেখা যায় একদল বাঙালি যুবক মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য এক বৃদ্ধ সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অত্যাচারী নবাবি শাসনের অবসান ঘটানোর শপথ নেয় । এই উদ্দেশ্যে তারা গভীর অরণ্যে আশ্রম তৈরি করে বাস করে সেখানে তারা মাতৃমূর্তি অর্থাৎ দেশজননীর প্রতিষ্ঠা করে । এভাবেই দেশভক্তি উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে ওঠে । যুবক সন্তান দলের ত্যাগ, বৈরাগ্য ও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব সমর্পণের আদর্শ পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতের বিপ্লবীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে ।

ওয়াল্টার স্কট রচিত 'ওল্ড মর্টালিটি' উপন্যাসে বর্ণিত বিদ্রোহের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের কাহিনির কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে । দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে 'কভেনান্টার' নামে স্কটল্যান্ডের সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইংল্যান্ডের রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । জন্মভূমিকে মাতৃদেবীর সঙ্গে তুলনা করায় স্বদেশবাসীর অন্তরে দেশাত্মবোধ সঞ্চারিত হয় । 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ সংগীত 'বন্দেমাতরম' পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের 'জাতীয় মন্ত্রে' পরিণত হয় । বিপ্লবীরা এই মন্ত্র উচ্চারণ করে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে থাকে । বিপ্লবী আন্দোলনের সময় দেখা যায় বিপ্লবীরা একহাতে আনন্দমঠ এবং অন্য হাতে গীতা নিয়ে মাতৃমুক্তি যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে আনন্দমঠের বন্দেমাতরম মন্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় । 'বিপ্লববাদের জননী' ভিকাজি রুস্তম কামা যিনি মাদাম কামা নামে পরিচিত ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পরাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরি করলে সেখানে 'বন্দেমাতরম' মন্ত্রটি স্থান পায় । স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলিতে বন্দেমাতরম মন্ত্র বিপ্লবীদের বীজমন্ত্র হয়ে ওঠে । আনন্দমঠ উপন্যাসে ভারতের জাতীয় সংগীত 'বন্দেমাতারাম' ইংরেজদের 'গড সেব দ্য কিং', ফরাসিদের 'দাস মারসেই-মেইজ', জার্মানদের 'হেইল-ডির সিয়োজারভানজ', ইতালীয়দের 'লা মারসিয়া রিয়েল' প্রভৃতি জাতীয় সংগীতের থেকে এগিয়ে কারণ বন্দেমাতরম -এর মধ্যে এক বৃহৎ জাতির আত্মজাগরণের মন্ত্র লুকিয়ে ছিল, তা অন্য দেশের জাতীয় সংগীতে ছিল না । তাই আনন্দমঠ উপন্যাসকে জাতীয় জাগরণের অন্যতম উৎস বলা হয় ।

****

Comments

Related Items

সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় হিন্দুসমাজে নারীরা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকর হতেন । এই সব নির্যাতনের মধ্যে অন্যতম ছিল সতীদাহপ্রথা বা সহমরণ । এই প্রথা অনুযায়ী ঊনিশ শতকের সূচনালগ্নেও বাংলা তথা ভারতীয় হিন্দুসমাজে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় তার বিধবা...

উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্মসমাজ সমূহের উদ্যোগ

উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলার সমাজজীবনে বিভিন্ন ধরণের কুপ্রথা প্রচলিত ছিল । সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসীপ্রথা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, কৌলিন্য প্রথা, গঙ্গাজলে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি নানান অমানবিক কুপ্রথা ও মানুষের মনে অন্ধবিশ্বাস বাংলার সমাজজীবনকে জর্জরিত

উনিশ শতকের বাংলা — সমাজ সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

উনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলায় ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সময় বাংলার সমাজজীবনে চরম দুর্দিন চলছিল । হিন্দুসমাজে তখন ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তারাই সমাজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন । হিন্দুসমাজে প্রকট জাতিভেদ প্রথা চালু ছিল । হিন্দুসমাজ ছিল

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষার বিকাশ

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড শিক্ষানীতির ওপর একটি পরিকল্পনা পেশ করেন যা 'উডের ডেসপ্যাচ' নামে পরিচিত । এই শিক্ষা পরিকল্পনায় যে সমস্ত সুপারিশগুলি করা হয় সেগুলির মধ্যে অন্যতম

মধুসূদন গুপ্ত

ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা প্রসারের সঙ্গে মধুসূদন গুপ্তের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত । তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ডেভিড হেয়ারের 'পটলডাঙ্গা স্কুলে' প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নিয়ে পড়াশুনা ...