আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 09/25/2020 - 10:48

আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসাবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব :

(২) আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা : আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । ব্রিটিশ শাসনকালে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত মহান ব্যক্তিগণ তাঁদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনা বর্ণনা করেছেন, তেমনিই আবার রাজনীতি বহির্ভূত লেখক ও সাধারণ মানুষও আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখেছেন । এই ধরনের সাহিত্য থেকে সমাজ-সংস্কৃতির একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায় । এই রকম অসংখ্য রচনা থেকে আলোচনার জন্য তিনটি আত্মজীবনী বেছে নেওয়া হয়েছে ।  সেগুলি হল — (ক) বিপিনচন্দ্র পাল রচিত 'সত্তর বৎসর',  (খ) কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি' ও  (গ) সরলাদেবী চৌধুরানির লেখা 'জীবনের ঝরাপাতা' ।

(ক) সত্তর বৎসর: বিখ্যাত চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে ওই পত্রিকায় তাঁর আত্মজীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন । কিন্তু অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই লেখাটি বন্ধ হয়ে যায় । তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । প্রথমে তিনি তাঁর আত্মজীবনী লিখতে চান নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন তিনি তাঁর আত্মজীবনী লিখতে রাজি হন, তা তাঁর কথাতেই বলা যায় যে— "আমার এই জীবনস্মৃতি বা আত্মচরিত যদি কেবল আমার নিজের কথা হইত, ইহাকে লোকসমাজে প্রচার করা সঙ্গত হইত না । কিন্তু আমার সত্তর বৎসরের জীবনকথা বাস্তবিক এই বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাসের কথা ··· ।" তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বহু মূল্যবান তথ্য আমরা তাঁর রচনার থেকে পাই । কীভাবে ধর্মপ্রাণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেছিল, তিনি তাঁর সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন । সামাজিক ইতিহাসের বেশকিছু তথ্য আমরা তাঁর বই থেকে পাই । তাঁর রচনায় পুরোনো কলকাতার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্থ্য বলে বিবেচিত হয় । তাঁর জন্মস্থান শ্রীহট্টের অন্তর্গত পল্লীগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল, তিনি তাঁর নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন । গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ওপর তিনি আলোকপাত করেছেন । সেকালের প্রেসিডেন্সি কলেজের সুন্দর বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখায় । রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি সুরেন্দ্রনাথ ও আনন্দমোহনের কথা উল্লেখ করেছেন । নবগোপাল মিত্র ও হিন্দুমেলার কথাও তাঁর আত্মজীবনীতে ঠাঁই পেয়েছে । নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসুকে তিনি স্বদেশির প্রথম পুরোহিত বলে উল্লেখ করেছেন । ব্রাহ্মসমাজের অনেক কথাই আমরা তাঁর গ্রন্থ থেকে জানতে পারি ।

(খ) জীবনস্মৃতি: আধুনিক ভারতের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা । এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আত্মজীবনী 'জীবনস্মৃতি' আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে । 'জীবনস্মৃতি' প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । পরে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে নানা তথ্য, ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ কেমন ছিল তার খুঁটিনাটি বিবরণ 'জীবনস্মৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায় । কীভাবে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল, সেকথাও তিনি বলেছেন । সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকে তিনি কখন কীভাবে দেখেছেন, তার বিবরণ পাওয়া যায় । ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্য সংক্রান্ত নানা তথ্য রয়েছে 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থে । রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম জীবনের স্মৃতির সূত্র ধরে বাল্যজীবনের ঘরোয়া পরিবেশ ও সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন । তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মতো অভিজাত পরিবারের সন্তানরা বাল্যকালে মা-বাবা গুরুজনদের পরিবর্তে মূলত পরিচারকদের তত্ত্বাবধানে বড়ো হয়ে উঠতেন । এই সমস্ত পরিচারকরা ছোটোদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাত । ঠাকুরবাড়ির এই বিষয়টি তৎকালীন সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৈশিষ্ট্যকেই সূচিত করে । জীবনস্মৃতি গ্রন্থে শহর কলকাতার চাকচিক্য ও সৌখিনতার পাশাপাশি পল্লীস্বভাবের চিহ্নও ধরা পড়ে । রাজনীতির কথা সেভাবে কবি লেখেননি । কিন্তু স্বল্প পরিসরে 'স্বাদেশিকতা' নিয়ে সরস ভাষায় অনবদ্য রচনা তিনি লিখেছেন, তা ইতিহাসের যে-কোনো ছাত্রকে মুগ্ধ করে । স্বদেশিকতার আবেগ নিয়ে সুন্দর ও মজার বর্ণনা জীবনস্মৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায় ।

(গ) জীবনের ঝরাপাতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানির লেখা 'জীবনের ঝরাপাতা' বাংলা সাহিত্যের একটি মূল্যবান আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা । তাঁর আত্মজীবনী ১৯৪৪ - ৪৫ খ্রিস্টাব্দে 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় । এই গ্রন্থ থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার নানান তথ্য পাওয়া যায় । এই আত্মজীবনী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অপরিহার্য গ্রন্থ । স্বাধীনতা সম্পর্কে সরলাদেবী চৌধুরানির ধারণা ছিল মৌলিক ও বিপ্লবী । তাঁর ভাষায় বলা যায়— "আমরা যারা আরামে আয়েসে মানুষ তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা একটা ভাবের বিলাসমাত্র । 'পরাধীনতার বা দাসত্ব-শৃঙ্খলে' -র প্রকৃত মর্ম আমরা কি জানি ? হাড়ে হাড়ে জেনেছিল আমাদের একপুরুষ আগে নীলকুঠির ক্রীতদাসেরা, ..... আর এখন জানছে ..... চা-বাগানের কুলিরা ।" তিনি সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতার লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হতে চেয়েছিলেন । এই ধরনের আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নানাভাবে জড়িত ছিলেন, তার বিবরণ এই গ্রন্থে পাওয়া যায় । স্বদেশী দ্রব্যের উৎপাদন ও তা ব্যবহারের জন্য তিনি 'লক্ষীর ভান্ডার' নামে প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন । তাঁর আত্মজীবনী থেকে তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাস, নানা সামাজিক তথ্য ও ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে নানান তথ্য পাওয়া যায় ।

*****

Comments

Related Items

নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল ? এই সময়ের দুটি ব্যঙ্গাত্মক বাংলা নাটকের নাম কর । নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

প্রশ্ন:- নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল ? এই সময়ের দুটি ব্যঙ্গাত্মক বাংলা নাটকের নাম কর । নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

বাংলায় সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যাবলি উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:-  বাংলায় সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যাবলি উল্লেখ কর ।

প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন ? জ্যোতিবা ফুলে কেন স্মরণীয় ? উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি সমাজে কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রশ্ন:- প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন ? জ্যোতিবা ফুলে কেন স্মরণীয় ? উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি সমাজে কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডঃ আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ ।

উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল ? ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ? ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন:- উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল ? ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ? ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল—

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে চার্লস উডের প্রতিবেদনে কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল ?

প্রশ্ন:- ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে চার্লস উডের প্রতিবেদনে কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল ?

শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় । এই কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল—