হিমবাহের সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ (Landform produced by Glacial Deposition) :
গ্রাবরেখা (Moraine) : হিমবাহের সঞ্চয়কাজের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, গ্রাবরেখা হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার সময় ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের সঙ্গে বাহিত হয়ে নীচের দিকে অগ্রসর হয় । এই সময় উপত্যকার বিভিন্ন অংশে এইসব বিচ্ছিন্ন ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখণ্ড বা শিলাচূর্ণের কিছু অংশ হিমবাহের দু’পাশে, সামনে ও তলদেশে স্তূপাকারে সঞ্চিত হয় । এইরূপ সঞ্চিয়জাত ভুমিরূপকে গ্রাবরেখা বলে ।
গ্রাবরেখার শ্রেণিবিভাগ (Classification of Moraine) : গ্রাবরেখার অবস্থান অনুযায়ী গ্রাবরেখা নানা ধরনের হয়, যেমন:- (i) পার্শ্ব গ্রাবরেখা, (ii) মধ্য গ্রাবরেখা, (iii) প্রান্ত গ্রাবরেখা, (iv) ভূমি গ্রাবরেখা, (v) হিমাবদ্ধ গ্রাবরেখা ।
(i) পার্শ্ব-গ্রাবরেখা (Lateral Moraine) : পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার সময় ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের সঙ্গে বয়ে চলে । এই সব বিচ্ছিন্ন ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখন্ডের কিছু অংশ হিমবাহের গতিপথের দু-পাশে স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়ে যে ভূমিরূপ গড়ে উঠে, তাকে পার্শ্ব-গ্রাবরেখা বলে ।
(ii) মধ্য-গ্রাবরেখা (Medial Moraine) : পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার সময় ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের সঙ্গে বয়ে চলে । এই সব বিচ্ছিন্ন ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখন্ডের কিছু অংশ পাশাপাশি দুটি হিমবাহের মিলনস্থলের মধ্যভাগে হিমবাহের গতিপথে সঞ্চিত হয়ে যে গ্রাবরেখা গঠিত হয়, তাকে মধ্য গ্রাবরেখা বলে ।
(iii) প্রান্ত-গ্রাবরেখা (Terminal Moraine) : পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার সময় ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের সঙ্গে বয়ে চলে । এই সব বিচ্ছিন্ন ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখন্ড বা শিলাচূর্ণ, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহ যে স্থানে এসে সম্পূর্ণরূপে গলে যায় সেখানে স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়ে যে গ্রাবরেখা গঠিত হয়, তাকে প্রান্ত গ্রাবরেখা বলে ।
(iv) ভূমি গ্রাবরেখা (Ground Moraine) : পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার সময় ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখন্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের সঙ্গে বয়ে চলে । এই সব বিচ্ছিন্ন ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখন্ড বা শিলাচূর্ণ, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের নীচে ভূপৃষ্ঠে স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়ে যে গ্রাবরেখা গঠিত হয়, তাকে ভূমি গ্রাবরেখা বলে ।
(v) হিমাবদ্ধ গ্রাবরেখা : পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার সময় ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখন্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের সঙ্গে বয়ে চলে । এই সমস্ত শিলাখণ্ড বা শিলাচূর্ণ, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহের ফাটলের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে ও স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়ে যে গ্রাবরেখা গঠিত হয়, তাকে হিমাবদ্ধ গ্রাবরেখা বলে ।
উদাহরণ: তিস্তা নদীর উচ্চ অববাহিকায় লাচুং ও লাচেন অঞ্চলে নানা ধরনের গ্রাবরেখা দেখা যায় ।
অবক্ষেপ (Drift): পর্বতের নিম্নাংশ ও নিম্নভূমিতে হিমবাহ প্রধানত অবক্ষেপণ করে থাকে । নদী যেমন তার বাহিত বস্তুগুলিকে যথা- নুড়ি, পাথর, কাদা, বালি, কাঁকর প্রভৃতি আকৃতি অনুসারে বিভিন্ন অংশে সঞ্চিয় করে, হিমবাহ তা করে না । হিমবাহ উপর থেকে বিভিন্ন আকৃতির শিলাচূর্ণ একই সঙ্গে নিয়ে এসে এক জায়গায় জমা করে, এগুলিকে একত্রে অবক্ষেপ বলে ।
আগামুক বা ইরাটিক (Erratics) : হিমবাহ উপর থেকে বিভিন্ন আকৃতির শিলাচূর্ণ একই সঙ্গে নিয়ে এসে এক জায়গায় জমা করে, এগুলিকে একত্রে অবক্ষেপ বলে । হিমবাহ অবক্ষেপিত বৃহৎ শিলাখন্ডগুলির সঙ্গে আঞ্চলিক শিলাসমূহের আকৃতিগত ও প্রকৃতিগত কোনো সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় না, তাই ওই হিমবাহ অবক্ষেপিত বৃহৎ শিলাখন্ডগুলিকে আগামুক বলে । কাশ্মীরের পহেলগামের উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে এই ধরনের আগামুক দেখা যায় ।
বোল্ডার ক্লে (Boulder Clay) : হিমবাহ গলে গেলে তার নীচে হিমবাহের সঙ্গে বয়ে আনা বালি ও কাদার সঙ্গে বিভিন্ন আকৃতির নুড়ি-পাথর অবক্ষেপ হিসাবে সঞ্চিত হলে তাদের একসঙ্গে বোল্ডার ক্লে বা হিমকর্দ বলা হয় ।
ড্রামলিন (Drumlin) : হিমবাহ ও হিমবাহগলিত জলধারার মিলিত সঞ্চয়কার্যের ফলে হিমবাহের পাদদেশে বহিঃধৌত সমভূমিতে বা তার কাছে যেসব ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ড্রামলিন হল তার মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপের নিদর্শন । হিমবাহ গলে গেলে তার নীচে হিমবাহের সঙ্গে বয়ে আনা বালি ও কাদার সঙ্গে বিভিন্ন আকৃতির নুড়ি-পাথর অবক্ষেপ হিসাবে সঞ্চিত হলে তাদের একসঙ্গে বোল্ডার ক্লে বা হিমকর্দ বলা হয় । স্তুপিকৃত বোল্ডার ক্লে অনেক সময়ে সারিবদ্ধ টিলা বা ছোটো ছোটো স্তুপের আকারে বিরাজ করে । ভূ-পৃষ্ঠের উপর এদের দেখতে অনেকটা উলটানো নৌকা বা উলটানো চামচের মতো আকৃতির হয় । এই চামচের মতো আকৃতির ভূমিরূপকে ড্রামলিন বলা হয় । বিজ্ঞানী ফ্লিন্ট -এর মতে একটি আদর্শ ড্রামলিন গড়ে ১৫-৩০ মি. উঁচু, দৈর্ঘ্যে ১-২ কিমি. এবং প্রস্থে ৪০০-৬০০ মি. হয়ে থাকে । যে সব জায়গায় একসঙ্গে অসংখ্য ড্রামলিন একত্রে অবস্থান করে সেই জায়গাকে দূর থেকে ডিম ভরতি ঝুড়ির মতো দেখতে লাগে । এজন্য ড্রামলিন অধ্যুষিত অঞ্চলকে ডিমের ঝুড়ি ভূমিরূপ (Basket of Egg Topography) বলা হয় ।
আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে এই ধরনে অসংখ্য ড্রামলিন দেখা যায় ।
এসকার (Esker) : হিমবাহ ও জলধারার মিলিত সঞ্চয়কার্যের ফলে নানা রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, এসকার হল তার মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপের নিদর্শন । উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশে হিমবাহের বহন করে আনা বিভিন্ন আকৃতির প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি, কাদা, বালি, কাঁকর প্রভৃতি হিমবাহগলিত জলধারার মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে পর্বতের পাদদেশে সঞ্চিত হয়ে যে দীর্ঘ অনুচ্চ সংকীর্ণ শৈলশিরার মতো আঁকা-বাঁকা ভূমিরূপ গড়ে তোলে, তাকে এসকার বলে । এসকার -এর দৈর্ঘ্য ১ কিমি. থেকে কয়েকশো কিমি. এবং উচ্চতা ৩ মি. থেকে ৫ মি. হয়ে থাকে ।
ফিনল্যান্ডর পুনকাহারয়ু এসকারের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ।
কেম (kames) : হিমবাহ ও জলধারার মিলিত সঞ্চয়কার্যের ফলে নানা রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, কেম হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । অনেক সময় পার্বত্য হিমবাহের শেষপ্রান্তে হিমবাহ যেখানে গলতে শুরু করে সেখানে কাদা, বালি, নুড়ি, পাথর, কাঁকর ইত্যাদি স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়ে ত্রিকোণাকার বদ্বীপের মতো যে ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, তাকে কেম বলে । এগুলি উপত্যকার পার্শ্বদেশের সঙ্গে মিশে ধাপ তৈরি করে । হিমবাহ উপত্যকার দু'পাশে স্তরে স্তরে অথবা একের ওপরে আরেকটি কেম গঠিত হলে, তাকে কেম সোপান বলে ।
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের নরফেকের গ্লাভেন উপত্যকায় কেম ও কেম সোপান দেখা যায় ।
বহিঃধৌত সমভূমি (Out-wash plains) : হিমবাহ ও হিমবাহগলিত জলধারার মিলিত সঞ্চয়কার্যের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, বহিঃধৌত সমভূমি হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । উচ্চ পর্বতের পাদদেশে হিমবাহ এসে পৌঁছালে তা গলে গিয়ে জলে পরিণত হয়, তখন বরফগলা জলপ্রবাহের মাধ্যমে হিমবাহবাহিত প্রস্তরখণ্ড, পলি, বালি, নুড়ি, কাঁকর প্রভৃতি পদার্থসমূহকে পর্বতের পাদদেশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সঞ্চিত করে সমপ্রায়ভূমি গড়ে তোলে । এরূপ সমপ্রায়ভূমিকে বহিঃধৌত সমভূমি বলে । আইসল্যাণ্ডে ইহা সান্দুর নামে পরিচিত ।
উত্তর আমেরিকার কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ হ্রদ অঞ্চলে এরূপ সমভূমি দেখা যায় ।
হিমশৈল (Iceberg) : মেরু উপকূলে হিমবাহ সাগর জলে নেমে এলে তরঙ্গের আঘাতে ভেঙ্গে বিশাল বরফের স্তূপ বিচ্ছিন্ন হয়ে সংলগ্ন মহাসাগরে ভেসে বেড়ায় । সমুদ্রে ভাসমান এইসব বিশাল বরফের স্তূপকে হিমশৈল বলে । হিমশৈল মাত্র ১/৯ অংশ সমুদ্রে ভেসে থাকে । এই রকম একটি হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে টাইটানিক জাহাজ তার প্রথম যাত্রাতেই গভীর সমুদ্রে ডুবে যায় ।
*****
- 9648 views