হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 05/23/2012 - 07:58

হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ :

বার্গস্রুন্ড (Bergschurnd) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, বার্গস্রুন্ড হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । হিমবাহ যখন উঁচু পার্বত্য উপত্যকা বেয়ে নীচের দিকে নেমে আসতে থাকে, তখন অনেক সময় অসমতল পর্বতের খাঁজকাটা গা এবং হিমবাহের মধ্যে ফাটলের সৃষ্টি হয়, এই সমস্ত ফাটলগুলিকে বার্গস্রুন্ড বলে । বার্গস্রুন্ড কেবলমাত্র গ্রীষ্মকালেই পরিলক্ষিত হয় । বছরের অন্য সময় এইসব ফাটলগুলি পাতলা তুষার দ্বারা ঢেকে যায়, তখন এদের উপস্থিতি ওপর থেকে বোঝা যায় না । এই জন্য কখনো কখনো বার্গস্রুন্ডগুলি পর্বতারোহিদের কাছে চরম বিপদসংকুল হয়ে ওঠে ।

ক্রেভাসেস (Crevasses) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ক্রেভাসেস হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । হিমবাহ যখন উঁচু পার্বত্য উপত্যকা বেয়ে নীচের দিকে নেমে আসতে থাকে, তখন অনেক সময় অসমতল পর্বতের খাঁজকাটা গা এবং হিমবাহের মধ্যে ফাটলের সৃষ্টি হয় । হিমবাহের গায়ে পর পর কয়েকটি ফাটল ধরলে তাকে ক্রেভাসেস বলে । হিমবাহ যদি আগাগোড়া সমান ঢাল বিশিষ্ট অঞ্চল এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তবে ক্রেভাসেস -এর সৃষ্টি হয় না । কিন্তু যখন হিমবাহ উপত্যকার ঢাল বেড়ে যায় হিমবাহের বিভিন্ন অংশের মধ্যে গতির পার্থক্য ঘটায় । ফলে হিমবাহের পৃষ্ঠে টান পড়ে, তখনই ক্রেভাসেসের সৃষ্টি হয় ।

সার্ক (Cirque) বা করি (Corrie) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, সার্ক বা করি হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । হিমবাহের অত্যাধিক চাপ ও ঘর্ষনের ফলে উপত্যকার উপরের অংশ খুব খাড়াই হয় এবং মধ্য অংশে অনেকটা গর্তের মতো অবনত জায়গার সৃষ্টি হয় । হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে পুরো উপত্যকাটির আকৃতি অনেকটা হাতল ছাড়া ডেক চেয়ারের মতো দেখতে হয় । এই রকম আকৃতিবিশিষ্ট উপত্যকাকে ফরাসি ভাষায় সার্ক এবং ইংরেজিতে কুম [Cumbe, Cwm] বা করি বলে । উপত্যকা হিমবাহের উৎসক্ষেত্রে ক্ষয়কাজের ফলে সার্কের সৃষ্টি হয় । পার্বত্য উপত্যকাটি যতদিন পর্যন্ত হিমবাহে চাপা থাকে ততদিন সার্ক দেখা যায় না, হিমবাহ সরে গিয়ে উপত্যকাটি বরফযুক্ত হলে তবেই সার্ক দেখা যায় ।

অ্যারেট (Aretes) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, অ্যারেট হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । হিমবাহের অত্যাধিক চাপ ও ঘর্ষণের ফলে অবঘর্ষ ও উৎপাটন প্রক্রিয়ায় হিমবাহের ক্ষয়কার্যের দ্বারা উপত্যকার উপরের অংশ খুব খাড়াই হয় এবং মধ্য অংশে অনেকটা গর্তের মতো অবনত জায়গার সৃষ্টি হয় । হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে পুরো উপত্যকাটির আকৃতি অনেকটা হাতল ছাড়া ডেক চেয়ারের মতো দেখতে হয় । এই রকম আকৃতিবিশিষ্ট উপত্যকাকে ফ্রান্সে স্থানীয় ভাষায় সার্ক এবং স্কটল্যান্ডে কুম বা করি বলে । উপত্যকা হিমবাহের উৎসক্ষেত্রে ক্ষয়কাজের ফলে সার্কের সৃষ্টি হয় । পাশাপাশি অবস্থিত দুটি করির মাঝখানের বিভাজিকা অঞ্চলটি ক্ষয় পেতে পেতে সংকীর্ণ হয়ে তীক্ষ্ণ প্রাচীরের আকার ধারণ করে, একে অ্যারেট বলে । অ্যারেট -এর শীর্ষদেশ ছুরির ফলার মতো অথবা করাতের দাঁতের মতো খাঁজকাটা হয়ে থাকে । এগুলির কোনো অংশ যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে এক সার্ক থেকে অন্য সার্কে যাওয়ার 'গিরিপথ' সৃষ্টি হয় । 

হিমালয় এবং কারাকোরাম পর্বতে অনেক অ্যারেট দেখা যায় ।

পিরামিড চূড়া (Pyramidal Peak) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে নানা রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, পিরামিড চূড়া হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । হিমবাহের অত্যাধিক চাপ ও ঘর্ষণের ফলে অবঘর্ষ ও উৎপাটন প্রক্রিয়ায় হিমবাহের ক্ষয়্কার্যের মাধ্যমে উপত্যকার উপরের অংশ খুব খাড়াই হয় এবং মধ্য অংশে অনেকটা গর্তের মতো অবনত জায়গার সৃষ্টি হয় । হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে পুরো উপত্যকাটির আকৃতি অনেকটা হাতল ছাড়া ডেক চেয়ারের মতো দেখতে হয় । এই রকম আকৃতিবিশিষ্ট উপত্যকাকে ফ্রান্সে স্থানীয় ভাষায় সার্ক এবং স্কটল্যান্ডে কুম বা করি বলে । উপত্যকা হিমবাহের উৎসক্ষেত্রে ক্ষয়কাজের ফলে সার্কের সৃষ্টি হয় । যখন একটি পাহাড়ের বিভিন্ন দিক থেকে তিন-চারটি করি বা সার্ক পাশাপাশি এক সঙ্গে বিরাজ করে, তখন এদের মধ্যবর্তী খাড়া পর্বত চূড়াটিকে পিরামিডের মতো দেখায় । পিরামিডের মতো আকৃতিবিশিষ্ট এই ধরনের পর্বত চূড়াকে পিরামিড চূড়া বলে ।

উদাহরণ: আল্পস পর্বতের ম্যাটারহর্ণ এবং গঙ্গোত্রীর কাছে অবস্থিত হিমালয় পর্বতের নীলকন্ঠশিবলিঙ্গ শৃঙ্গ দুটি পিরামিড চুড়ার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ।

কর্তিত স্পার (Truncated Spur) : পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে যখন হিমবাহ নীচের দিকে অগ্রসর হয়, সে সময় এই হিমবাহের গতিপথে যেসব স্পার (Spur) বা পর্বতের অভিক্ষিপ্তাংশ হিমবাহের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে, হিমবাহ সেগুলিকে কেটে বা ক্ষয় করে সোজা পথে অগ্রসর হয় এবং খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে । এর ফলে পর্বতশিরার অবতল ও উত্তল ঢালটি হঠাৎ খাড়াভাবে হিমবাহ উপত্যকায় নেমে আসে । এইভাবে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ত্রিভূজের মতো দেখতে শৈলশিরাগুলোকে কর্তিত স্পার বা পল কাটা স্পার বলে । যে কোনো নদীর পার্বত্য গতিপথে এই ধরনের বাধা থাকলে নদীটি এঁকে বাঁক প্রবাহিত হয়, যার ফলে আড়াআড়ি পাড় বা অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ (Interlocking Spur) -এর সৃষ্টি হয় । হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীর গতিপথে কর্তিত শৈলশিরা দেখা যায় ।

U - আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি (U -Shaped Valley or Glacial Trough) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে নানা রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, U -আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণী হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ যে উপত্যকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় যেখানে হিমবাহের ক্রমাগত পার্শ্বক্ষয় ও নিম্নক্ষয় সমানভাবে হওয়ার ফলে উপত্যাকার তলদেশ প্রশস্ত ও মসৃণ এবং পার্শ্বদেশ খাড়া ঢালযুক্ত হয় । ফলে পার্বত্য উপত্যকাটির আকৃতি ইংরেজি ‘U’ -অক্ষরের মতো হয়ে যায়, একে U -আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি বলে । হিমবাহ কোনো নদী উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলে হিমবাহ ও নদীর একই সঙ্গে ক্ষয়কাজের ফলে বেশিরভাগ হিমদ্রোণি গড়ে ওঠে বলে বিজ্ঞানীরা অভিমত পোষণ করেন । অনেক সময় হিমদ্রোণির মধ্যে হিমবাহ গলা জল জমে হ্রদের সৃষ্টি হয় ।

রসে মতানে (Roche Moutonnee) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত নানা রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, রসে মতানে হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । অনেক সময় উপত্যকার মধ্যে উঁচু ঢিবির মতো কঠিন শিলাখন্ডের ওপর দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হয় । অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায়  হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে হিমবাহের প্রবাহের দিকে অর্থাৎ প্রতিবাত ঢালে শিলাখন্ডটি মসৃণ ও চকচকে হয়ে ওঠে এবং বিপরীত দিকটি বা অনুবাত ঢালে উৎপাটন প্রক্রিয়ায় অমসৃণ ও খাঁজকাটা হয়ে যায় । পার্বত্য হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে শক্ত শিলাখন্ডে গঠিত একদিকে মসৃণ এবং আর এক দিকে এবড়ো-খেবড়ো এইরকম শিলাখন্ড বা ঢিবিকে রসে মতানে বলা হয় । রসে মতানে হল পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কাজের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন ।

ঝুলন্ত উপত্যকা (Hanging Valley) : উপত্যকা হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ঝুলন্ত উপত্যকা হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । নদী অববাহিকায় উপনদীগুলি যেমন মূল নদীতে এসে মিলিত হয় তেমনি পার্বত্য অঞ্চলে ছোটো ছোটো উপ হিমবাহগুলি প্রধান হিমবাহের সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকে । অধিক ক্ষয়কার্যের ফলে প্রধান হিমবাহ উপত্যকাটি ছোটো ছোটো হিমবাহ উপত্যকাগুলির তুলনায় অনেক বড় ও গভীর হয় । এই অবস্থায় হিমবাহ সরে গেলে মনে হয় যেন ছোটো ছোটো হিমবাহ উপত্যকাগুলি প্রধান হিমবাহ উপত্যকার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে । তখন একে ঝুলন্ত উপত্যকা বলা হয় ।

ঝুলন্ত উপত্যকা থেকে হিমবাহ সরে গেলে এর প্রান্তভাগে গভীর খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয় । তখন উপহিমবাহ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদী এই খাড়া ঢাল বেয়ে প্রবলবেগে নীচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে ।

উদাহরণ:- ভারতের গাড়োয়াল হিমালয়ের বদ্রীনাথের কাছে নর পর্বতের নীচের দিকে কুবের উপত্যকা এইরকম ঝুলন্ত উপত্যকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।

ক্র্যাগ টেল (Crag & Tail) : হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে নানা রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ক্র্যাগ টেল হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । হিমবাহের গতিপথে কঠিন শিলাস্তরের পিছনে নরম শিলাস্তর থাকলে, অনেক সময় কঠিন শিলাস্তরটি পশ্চাদবর্তী নরম শিলাস্তরটিকে হিমবাহের ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে । এর ফলে কঠিন শিলাস্তুপটি উঁচু ঢিপির মত আর পিছনের নরম শিলা কিছুটা কম ক্ষয় পেয়ে সরু লেজের আকারে অবস্থান করে । এই রকম উঁচু ঢিবির মত কঠিন শিলাকে ক্রাগ এবং পিছনের সরু লেজের মতো নরম শিলাকে টেল বলে । টেল অংশটি যতই ক্রাগ থেকে দূরে যায়, ততই সরু হয়ে পড়ে ।

*****

Related Items

নর্মদা নদী (The Narmada)

নর্মদা নদী (The Narmada) : মহাকাল পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অমরকন্টক থেকে উৎপন্ন হয়ে নর্মদা নদী উত্তর-পশ্চিমে বেঁকে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র হয়ে গুজরাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিন্ধ্য ও সাতপুরার সংকীর্ণ গিরিখাত অতিক্রম করে

ব্রহ্মপুত্র নদ (The Brahmaputra)

ব্রহ্মপুত্র নদ : তিব্বতের মানস সরোবরের নিকটবর্তী চেমায়ুং-দুং হিমবাহ থেকে সাংপো নামে উৎপন্ন হয়ে নামচাবারওয়া শৃঙ্গের কাছে চুলের কাটার মত বেঁকে অরুণাচল প্রদেশের মধ্য দিয়ে ডিহং নামে ভারতে প্রবেশ করেছে । এর মোট দৈর্ঘ্য ২,৯০০ কিমি, এর মধ্

সিন্ধু নদ (The Indus)

সিন্ধু নদ : সিন্ধু নদ তিব্বতের মানস সরোবরের উত্তরে অবস্থিত সিন-কা-বাব জলধারা থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তর-পশ্চিমে প্রথমে তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরে লাদাখ অঞ্চল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে । সিন্ধু নদের মোট দৈর্ঘ্য ৩,১৮০ কিমি এবং এর মধ

গঙ্গা নদী (The Ganges)

গঙ্গা নদী : গঙ্গা ভারতের শ্রেষ্ঠ নদী এবং ভারতের দীর্ঘতম নদী । গঙ্গানদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৫১০ কিমি এবং এর মধ্যে ২০১৭ কিমি ভারতে প্রবাহিত । কুমায়ুন হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ তুষার গুহা থেকে ভাগীরথী নামে উৎপন্ন হয়ে সংকীর্ণ গিরিখাতের

ভারতের নদনদী (Rivers of India)

ভারতের নদনদী : ভারতে অসংখ্য নদনদী বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছে । উৎস, প্রবাহের অঞ্চল, এবং মোহানা অনুসারে ভারতের নদনদীকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যেমন— (১) উত্তর ভারতের নদী এবং (২) দক্ষিণ ভারতের নদী ।