স্থানীয় বায়ুপ্রবাহ (Local wind)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 08/20/2012 - 11:37

স্থানীয় বায়ুপ্রবাহ (Local wind) :- কোনো কোনো উষ্ণ মরুভূমি, উঁচু পাহাড় প্রভৃতি অঞ্চলে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিতভাবে একরকম বায়ু প্রবাহিত হতে দেখা যায়, এই বায়ুপ্রবাহকে স্থানীয় বায়ু বলা হয় । স্থানীয় কারণ বশত বায়ুর তাপ ও চাপের তারতম্যের জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই বায়ু প্রবাহিত হয় । আঁধি, লু, কালবৈশাখী, চিনুক, ফন, খামসিন, সোলানো, সিরিক্কো, হারমাট্টান, মিস্ট্রাল, বোরাটাকু, পম্পেরো, বার্গ  প্রভৃতি স্থানীয় বায়ুপ্রবাহের উদাহরণ ।

আঁধি (Andhi):- উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিল্লি, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালের বিকেল বেলার দিকে কখনও কখনও এক রকমের ধুলোর ঝড় (Dust Storm) প্রবাহিত হতে থাকে, একে আঁধি বলে । আঁধির সময় বাতাস পরিচলন পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা সংগ্রহ করে প্রতি ঘন্টায় ৭০ - ১০০ কি.মি. বেগে প্রবাহিত হতে থাকে । আঁধি প্রবাহিত হলে বায়ুর তাপমত্রা কমে যায় ।

লু (Loo):-  উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক প্রকার উষ্ণ স্থানীয় বায়ুর নাম 'লু' । গ্রীষ্মকালে বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে দিনের বেলা ভারতের উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে মাথার ওপর লম্বভাবে প্রচন্ড সূর্যকিরণের ফলে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হওয়ার জন্য শোঁ-শোঁ শব্দ করে যে উত্তপ্ত বায়ু প্রচন্ড বেগে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়, তাকে লু বলে । এই বায়ু খুব উষ্ণ, শুষ্ক ও পীড়াদায়ক । লু-এর প্রভাবে বায়ুর তাপমাত্রা বাড়ে ।

কালবৈশাখী (Nor' wester):- বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গও পূর্ব ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে চৈত্র-বৈশাখ মাসে সূর্যের তাপে স্থানীয়ভাবে কিছু নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয় । সেই সময় বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বজ্র-বিদ্যুৎ ও বৃষ্টিপাতের সঙ্গে এক ভীষণ ঝড় প্রবলবেগে ছুটে আসে । এর নাম কালবৈশাখী । এর প্রভাবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু বৃষ্টিপাত হয় । কালবৈশাখীর প্রভাবে দিনের দুঃসহ গরম কমে যায় ।

(১) কালবৈশাখী একটি আকস্মিক বায়ুপ্রবাহ ।

(২) গ্রীষ্মকালের শুরুতে এপ্রিল-মে মাসে ছোটনাগপুর মালভূমি ও পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল প্রখর সূর্যতাপে দ্রুত উত্তপ্ত হয়, ফলে সেখানে স্থানীয়ভাবে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে, সেই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে প্রচন্ড বেগে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং উত্তরের শীতল বায়ু ছুটে আসে । এই দুই বিপরীতধর্মী বায়ুপ্রবাহের সংঘর্ষের ফলে যে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়, তাকেই কালবৈশাখী বলে ।

(৩) কালবৈশাখীর ঘূর্ণবাত সাধারণত উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ছুটে আসে, তাই একে ইংরেজিতে Nor’ Wester (নর-ওয়েস্টার) বলা হয় ।

(৪) কালবৈশাখীর বায়ু বেশ ঠান্ডা, তাই এই বায়ুপ্রবাহের প্রভাবে গ্রীষ্মের প্রচন্ড উষ্ণতা একলাফে অনেকটা কমে যায় ।

চিনুক (তুষার খাদক) (Chinook) : চিনুক এক প্রকার উষ্ণ স্থানীয় বায়ু । শীতকাল ও বসন্তকালে উত্তর আমেরিকার রকি পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রেইরি অঞ্চলের দিকে এক রকমের উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ু পর্বতের গা বেয়ে প্রবাহিত হয় ও নীচের দিকে নেমে আসে । এর নাম চিনুক । এর প্রভাবে প্রেইরি অঞ্চলের উষ্ণতা প্রায় ১৫° - ২০° সে. বেড়ে যায় এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমা বরফ গলে যায় । এজন্য এই বায়ুপ্রবাহকে রেড ইন্ডিয়ানরা স্নো ইটার (Snow Eater) বা তুষার খাদক বলে ।

ফন (Fohn):- শীতকালে ইউরোপের আল্পস পার্বত্য অঞ্চল থেকে জার্মানির রাইন নদীর উপত্যকার দিকে এক রকমের আর্দ্র ও উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হয় । এর নাম ফন । এর প্রভাবে রাইন উপত্যকা ও আল্পস পর্বতের উত্তর ঢালের বরফ গলে যায় এবং হিমানী সম্প্রপাত ঘটে ।

খামসিন (Khamsin):- সাহারা মরুভূমি অঞ্চল থেকে একরকম উষ্ণ, শুষ্ক, ধূলাপূর্ণ ও কষ্টদায়ক বায়ু   প্রবাহিত হয় । স্থানভেদে এই বায়ুপ্রবাহ বিভিন্ন নামে পরিচিত । মিশরে এর নাম খামসিন

সোলানো:- সাহারা মরুভূমি অঞ্চল থেকে উৎপন্ন উষ্ণ, শুষ্ক ও ধুলোপূর্ণ বায়ু স্পেনে সোলানো নামে পরিচিত । 

সিরিক্কো (Sirocco):- সিরোক্ক এক প্রকার উষ্ণ স্থানীয় বায়ু । গ্রীষ্মকালে আফ্রিকার লিবিয়া মরুভূমি থেকে এক ধরনের অতি উষ্ণ, শুষ্ক ও ধূলিপূর্ণ বায়ুপ্রবাহ উৎপন্ন হয়ে ভূমধ্যসাগরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে, এই বায়ুপ্রবাহকে সিরিক্কো বলে । ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করার সময় এই বায়ু জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে আর্দ্র ও উষ্ণ বায়ুতে পরিণ হয় এবং সিসিলি দ্বীপ, দক্ষিণ ইটালি প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে । ইউরোপের দক্ষিণ প্রান্তের কোনো কোনো অংশে লাল বা হলুদ ধূলিপূর্ণ বায়ুর জন্য লাল বা হলুদ বৃষ্টিপাত হয় । এর ফলে ইটালির জলপাই চাষে যথেষ্ঠ ক্ষতি হয় । 

হারমাট্টান (Hermattan):- উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় অবস্থিত সাহারা মরুভূমির পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে গিনি উপকূলের দিকে এক রকমের উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ু প্রবাহিত হয়, একে হারমাট্টান বলে । এই বায়ুপ্রবাহের ফলে আদ্র ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াযুক্ত গিনি উপকূলের আবহাওয়া শুষ্ক ও আরাম দায়ক হয় ।

মিস্ট্রাল (Mistral) : শীতকাল ও বসন্তকালে ইউরোপের আল্পস পর্বত থেকে দক্ষিণ ফ্রান্সের রোন উপত্যকার দিয়ে ভূমধ্যসাগরের অভিমুখে একরকমের শীতল ও শুষ্কবায়ু প্রবল গতিতে প্রবাহিত হয়, এই বায়ুপ্রবাহকে মিস্ট্রাল বলে । এই বায়ুর প্রভাবে রোন উপত্যকার তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে যায় ও পরিষ্কার ও রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়ার সৃষ্টি করে ।

বোরা (Bora) : শীতকালে ইউরোপের আল্পস পর্বত থেকে দক্ষিণ ইটালির আড্রিয়াটিক সাগরের উপকুলের দিকে এক রকমের শীতল ও শুষ্ক বায়ু প্রবাহিত হয়, এই বায়ুপ্রবাহকে বোরা বলে । এই বায়ু ঘন্টায় ১০০ কিমিরও বেশি গতিবেগে প্রবাহিত হয় । এই বায়ুর প্রভাবে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা কমে যায় শীতলতাকে বাড়িয়ে তোলে ।

টাকু :- শীতকালে সুমেরু অঞ্চল থেকে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত আলাস্কা উপদ্বীপের ওপর দিয়ে এক রকমের অতি শীতল বায়ু প্রবাহিত হয়, এই বায়ুপ্রবাহকে টাকু বলে । এই বায়ুপ্রবাহের ফলে আলাস্কা উপদ্বীপের অনেকাংশ তুষারাবৃত হয়ে পড়ে ।

পম্পেরো :-  বসন্তকালে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের আন্দিজ পর্বতের পাদদেশ থেকে আর্জেন্টিনার পম্পাস তৃণভূমি অঞ্চলের দিকে যে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হয়, তা পম্পেরো নামে পরিচিত । এই বায়ুপ্রবাহের ফলে পম্পাস অঞ্চলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় ।

বার্গ :- দক্ষিণ আফ্রিকার কালহারি মরুভূমি থেকে এক রকমের উষ্ণ বায়ু নিকটবর্তী দেশগুলিতে প্রবাহিত হয়, এই বায়ুপ্রবাহকে বার্গ বলে । এই বায়ুপ্রবাহের ফলে কালাহারি মরুভূমির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উষ্ণতা বেড়ে যায় ।

*****

Related Items

ভরা জোয়ার ও মরা জোয়ার (Spring Tides and Neap Tides)

ভরা কোটাল বা ভরা জোয়ার (Spring Tides) : পৃথিবীর সব জায়গায় সব দিন জোয়ারের পরিমাণ একই থাকে না । তিথি অনুসারে জোয়ারভাটা বাড়ে ও কমে । পৃথিবীর ওপর সূর্যের আকর্ষণ শক্তি চাঁদের আকর্ষণ শক্তির প্রায় অর্ধেক হলেও ভূপৃষ্ঠে জোয়ার ভাটা সৃষ্টিতে সূর্যের প্রভাবও বিশ

জোয়ার ভাটার সময়ের ব্যবধান

জোয়ার ভাটার সময়ের ব্যবধান : পৃথিবীর আবর্তন গতি ও পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চাঁদের পরিক্রমণ গতির ওপর জোয়ার ভাটার উৎপত্তি নির্ভর করে । ভূপৃষ্ঠের যে স্থানে যখন মুখ্য জোয়ার হয়, তার প্রতিপাদস্থানে তখন গৌণ জোয়ার হয় । আবর্তন গতির ফলে পৃথিবীর যে স্থানে যখন মু

মুখ্য জোয়ার, গৌণ জোয়ার ও ভাটা (Primary Tide, Secondary Tide and Low Tide)

মুখ্য জোয়ার (Primary or Direct Tide) : পৃথিবী যেমন তার অক্ষ বা মেরুদণ্ডের ওপর আবর্তন করে তেমনিই চাঁদও পৃথিবীর চারদিকে সর্বদা পরিক্রমণ করছে । পৃথিবীর আবর্তনের ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠের যে স্থান ঠিক চন্দ্রের সামনে এসে উপস্থিত হয়, সেখানে চন্দ্রে

জোয়ার ভাটা ও জোয়ার ভাটা সৃষ্টির কারণ (Tides and Causes of Tides)

জোয়ার ভাটা (Tides) : পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরে সমুদ্রস্রোত ও সমুদ্রতরঙ্গ ছাড়া আরও একটি গতি রয়েছে । এই গতির ফলে সমুদ্রের জল প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য কোনো এক জায়গায় ফুলে ওঠে এবং অন্য কোনো জায়গায় নেমে যায় । মূলত চাঁদের আকর্ষণী শক্তির

সমুদ্রস্রোতের প্রভাব (Effects of Ocean Currents)

সমুদ্রস্রোতের প্রভাব (Effects of Ocean Currents) : ভৌগলিক পরিবেশ ও মানুষের কাজকর্মের ওপর পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রে প্রবাহিত সমুদ্রস্রোতের নানা রকম প্রভাব দেখা যায় । যেমন —