রুই মাছের অভিযোজন (Adaptation of Rohufish)
রুই মাছ মুখ্য জলজ প্রাণী । জলে বসবাস করার জন্য এদের দেহে নিম্নলিখিত অভিযোজনগুলি দেখা যায় ।
[1] দেহাকৃতি [Body contour]:- রুই মাছের দেহ বেম বা মাকুর মতো । দেহ দু'পাশ থেকে চ্যাপ্টা এবং দেহ থেকে কোনো প্রবর্ধক বেরিয়ে থাকে না । জলে সাঁতার কাটার সময় জলের গতি রোধ করার জন্য দেহের গঠন এই রকম হয়েছে ।
[২] দেহাবরণ [Body covering]:- রুই মাছে সারাদেহ সাইক্লয়েড আঁশ দিয়ে ঢাকা থাকে । আঁশের পিচ্ছিল আবরণ রুই মাছকে আত্মরক্ষার করতে এবং চলনের সময় ঘর্ষণজনিত বাধা দূর করতে সাহায্য করে ।
[3] পাখনা [Fins]:- পাখনা হল রুই মাছের প্রধান গমন অঙ্গ । রুই মাছের দেহে রশ্মিযুক্ত জোড়-সংখ্যক বক্ষ পাখনা ও শ্রোণি পাখনা এবং বিজোড়-সংখ্যক পৃষ্ঠ পাখনা, পায়ু পাখনা এবং পুচ্ছ পাখনা থাকে । পাখনাগুলি রশ্মিবিশিষ্ট হওয়ায় জলের চাপে ছিঁড়ে যায় না । এইসব পাখনাগুলি রুই মাছের চলন, গমন, দিক পরিবর্তন করতে এবং জলের মধ্যে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে ।
[4] পার্শ্ব বা স্পর্শেন্দ্রিয় রেখা [Lateral line] :- রুই মাছের দেহের দু'পাশে কানকোর পিছন থেকে লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত দুটি পার্শ্ব বা স্পর্শেন্দ্রিয় রেখা থাকে । স্পর্শেন্দ্রিয় রেখা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কাজ করে । এর সাহায্যে মাছ জলের চাপ, তাপ, গভীরতা, pH -মাত্রা বুঝতে পারে, জলের স্রোতের দিক নির্ণয় করতে পারে, শব্দ গ্রহন করতে এবং দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে ।
[5] বায়ুথলি বা পটকা [Air-bladder]:- রুই এবং অন্যান্য অস্থিবিশিষ্ট মাছদের উদরগহ্বরে মেরুদন্ডের নীচে অবস্থিত একটি বায়ুথলি বা পটকা থাকে । পটকা মাছের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমিয়ে বা বাড়িয়ে যথাক্রমে মাছকে জলের ওপরে ভাসতে বা জলের গভীরে নামতে অথবা জলের যে-কোনো স্থানে স্থিতিশীল থাকতে সাহয্য করে ।
[6] শ্বসন অঙ্গ [Respiratory Organ]:- রুই মাছের শ্বসন অঙ্গ হল ফুলকা [gills] । গলবিলের উভয় দিকে ফুলকা-গহ্বরের মধ্যে মাছের ফুলকা অবস্থিত । রুই মাছের ফুলকা, কানকো [operculum] দিয়ে ঢাকা থাকে । ফুলকাগুলোতে রক্তজালক থাকে । জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন ব্যাপন ক্রিয়ায় রক্তজালকের রক্তে প্রবেশ করে এবং একই প্রক্রিয়ায় জালক থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড [CO2] নির্গত হয় ।
[7] হৃৎপিন্ড [Heart]:- মাছেদের হৃৎপিন্ড হল ভেনাস অর্থাৎ হৃৎপিন্ডের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয় । এদের হৃৎপিন্ড একটি অলিন্দ ও একটি নিলয় নিয়ে গঠিত ।
[8] চোখ [Eye]:- রুই মাছের চোখ দুটি পল্লবহীন এবং গোলাকার । প্রতিটি চোখে একটি করে পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, যা জলের ঘর্ষণ থেকে চোখকে রক্ষা করে ।
[9] নাসারন্ধ্র [Nostrils]:- মাছের বহিঃনাসারন্ধ্র আছে, কিন্তু অন্তঃনাসারন্ধ্র থাকে না । নাসারন্ধ্র কেবল ঘ্রাণকার্যে সাহায্য করে ।
[10] মায়োটোম পেশি [Myotome muscles]:- রুই মাছের মেরুদন্ডের দু'পাশে 'V' আকৃতিবিশিষ্ট মায়োটোম পেশি থাকে । এই পেশির সংকোচনের মাধ্যমে রুই মাছ সাঁতার কাটার সময় মেরুদন্ডকে দেহের দু'পাশে আন্দোলিত করতে পারে ।
রুই মাছের অভিযোজনের বৈশিষ্ট্য ও অভিযোজনগত গুরুত্ব
জলজ পরিবেশে অভিযোজিত অঙ্গ |
বৈশিষ্ট্য | অভিযোজনগত গুরুত্ব |
১. পাখনা | রুই মাছের দেহে রশ্মিযুক্ত জোড় সংখ্যক পাখনা (যেমন: বক্ষ পাখনা ও শ্রোণি পাখনা) এবং বিজোড় সংখ্যক পাখনা (যেমন: পৃষ্ঠ পাখনা, পায়ু পাখনা এবং পুচ্ছ পাখনা ) থাকে । | পাখনা মাছের প্রধান গমন অঙ্গ । এইসব পাখনাগুলি রুই মাছের চলন, গমন, দিক পরিবর্তন করতে এবং জলের মধ্যে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে । পাখনাগুলি রশ্মিবিশিষ্ট ও দৃঢ় কাঠামোযুক্ত হওয়ায় জলের চাপে ছিঁড়ে যায় না । |
২. পটকা | প্রত্যেক অস্থিযুক্ত মাছের মেরুদন্ডের নীচে উদর গহ্বরে একটি বায়ুপূর্ণ থলি বা পটকা থাকে । পটকা সাধারণত সামনের ও পিছনের প্রকোষ্ঠ দ্বারা গঠিত হয় । পটকার সামনের প্রকোষ্ঠে থাকা 'লালা গ্রন্থি' থেকে নির্গত গ্যাসে পটকা স্ফীত হলে মাছ জলে ভাসে, অপর দিকে পিছনের প্রকোষ্ঠে থাকা 'রেটিয়ামিরা-বিলিয়া' নামে রক্ত জালক ওই গ্যাস শোষণ করে নিলে মাছ জলে ডুবে যায় । | পটকা মাছের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমিয়ে বা বাড়িয়ে যথাক্রমে মাছকে জলের ওপরে ভাসতে বা জলের গভীরে নামতে অথবা জলের যে-কোনো স্থানে স্থিতিশীল থাকতে সাহয্য করে, এই জন্য পটকাকে মাছের 'জলস্থিতি অঙ্গ' বলা হয় । |
৩. ফুলকা | ফুলকা হল মাছের শ্বসন অঙ্গ । দেহের উভয় পাশে ফুলকা গহ্বরের মধ্যে মাছের ফুলকা থাকে । অস্থিযুক্ত মাছের ফুলকা কানকো দিয়ে ঢাকা থাকে । | ফুলকা রক্তজালকপূর্ণ হওয়ায় জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন (O2) ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুলকার রক্ত জালকে প্রবেশ করে এবং ওই একই প্রক্রিয়ায় ফুলকার রক্ত জালক থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) গ্যাস জলে নির্গত হয় । ফুলকার সাহায্যে এইভাবে জলে ডুবন্ত অবস্থাতেও মাছের শ্বাসকার্য চলে । |
৪. দেহাকৃতি | জলে বাস করার সুবিধার জন্য রুই মাছের দেহাকৃতি বেম বা মাকুর মতো হয়েছে, যা মাছকে জলের বাধা অতিক্রম করে দ্রুত সাঁতার কাটতে সাহায্য করে । | মাকুর মতো দেহের আকার এবং দেহের পার্শ্বদেশ চ্যাপ্টা হওয়ায় মাছ জলের মধ্যে দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে পারে । |
৫. চোখ | রুই মাছের মাথার দু'পাশে একটি করে মোট দুটি পল্লবহীন চোখ আছে । এছাড়া প্রতিটি চোখ নিকটিটেটিং পর্দা নামে এক ধরনের পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে । | পাতাবিহীন চোখের সাহায্যে মাছ সহজেই জলের মধ্যে দেখতে পায় । প্রতিটি চোখ নিকটিটেটিং পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকায় মাছের চোখগুলো জলের ঘর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায় । |
*****
- 20696 views