যান্ত্রিক আবহবিকার কাকে বলে ? যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি আলোচনা কর

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 12/26/2021 - 22:22

প্রশ্ন:- যান্ত্রিক আবহবিকার কাকে বলেযান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি আলোচনা কর ।

যান্ত্রিক আবহবিকার (Mechanical Weathering):- উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, তুষার, অভিকর্ষ, নদী, বায়ু, জীবজন্তু বা উদ্ভিদ প্রভৃতি নানা প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে শিলাস্তর যখন ছোটো ছোটো খন্ড বা চূর্ণে পরিণত হয়ে মূল শিলার ওপর অবস্থান করে, এবং তার মধ্যে যখন কোনোরকম রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে না, তখন তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলা হয় । যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে শিলাসমূহ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় । যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে না বা শিলার কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে না । এই আবহবিকারের ফলে শিলার ভৌত পরিবর্তন হয় । উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ু অঞ্চল, শুষ্ক মরু অঞ্চল, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বেশি উচ্চতা যুক্ত স্থানে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্য বেশি হয় । (১) তাপমাত্রার পরিবর্তনের জন্য ঘটা যান্ত্রিক আবহবিকারগুলি হল:- পিন্ডবিশরণ, শল্কমোচন, ক্ষুদ্রকণা বিশরণ;  (২) তুষারের দ্বারা তুহিন খন্ডীকরণ প্রভৃতি । এছাড়া জল এবং চাপ হ্রাসের ফলেও যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে থাকে ।

যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতি :- যান্ত্রিক বিচূর্ণীভবনের প্রধান কারণ হল চারটি, যথা:- (১) তাপমাত্রার পরিবর্তন, (২) তুষারপাত, (৩) বৃষ্টিপাত এবং (৪) শিলাস্তরের চাপ হ্রাস প্রাপ্ত হওয়া ।

(১) তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত যান্ত্রিক আবহবিকার :-

(ক) পিন্ড-বিশরণ (Block disintegration) :- যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতি গুলোর মধ্যে খন্ডবিখন্ডিকরণ বা পিন্ড বিশরণ হল অন্যতম একটি পদ্ধতি । শিলা তাপের সুপরিবাহী নয় । এই জন্য মরু অঞ্চলের গাছপালা হীন উন্মুক্ত প্রান্তরে দিনে এবং রাত্রে শিলার ভিতরের ও বাইরের অংশের উষ্ণতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য ঘটে । ক্রমাগত উত্তাপে প্রসারিত ও ঠান্ডায় সংকুচিত হতে হতে শিলার সন্ধিস্থল গুলি আলগা হয়ে যায় এবং শিলাগাত্রে ফাটলের সৃষ্টি হয় । এই ফাটলগুলি কালক্রমে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভগ্ন স্তূপে পরিণত হয় । এই ভেঙে যাওয়া শিলার আকৃতি অনেকটা বর্গক্ষেত্র বা আয়তক্ষেত্রের মতো হয় বলে আবহবিকারের এই বিশেষ প্রক্রিয়াটিকে চৌকাকার বিচূর্ণীভবন অথবা পিন্ড-বিশরণ বলে ।

(খ) গোলাকৃতি বিচূর্ণীভবন বা শল্কমোচন (Exfoliation):- যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতি গুলির মধ্যে গোলাকৃতি বিচূর্ণীভবন বা শল্কমোচন হল অন্যতম একটি পদ্ধতি । শিলাস্তর তাপের সুপরিবাহী না হওয়ার ফলে দিন ও রাতে শিলার ভিতরের ও বাইরের অংশের মধ্যে উষ্ণতার যথেষ্ট পার্থক্য ঘটে । উষ্ণতার এই তারতম্যের ফলে শিলাস্তরে ক্রমাগত প্রসারণ ও সংকোচন ঘটে । দীর্ঘদিন ধরে সংকোচন ও প্রসারণের ফলে শিলার ওপরের স্তর ওপরের দিকে প্রসারিত হয় । তখন ওপরের স্তর নীচের অপেক্ষাকৃত শীতল স্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পেঁয়াজের খোলার মতো খসে পড়ে । শিলার বাইরের অংশ এই ভাবে পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে গেলে ভিতরের অংশটি কিছুটা গোলাকার ও মসৃণ শিলাখন্ডে পরিণত হয় । এইভাবে সৃষ্টি হওয়া প্রধান গোলাকার শিলাটিকে ‘অবশিষ্ট গণ্ড-শিলা’ বলে । শল্কমোচনের ফলে শিলাখন্ডগুলি অনেকটা গোলাকার হয়ে যায়, তাই বিচূর্ণীভবনের এই বিশেষ প্রক্রিয়াকে গোলাকৃতি বিচূর্ণীভবন বা শল্কমোচন বলে । একই জাতীয় খনিজ পদার্থে গঠিত সমপ্রকৃতির শিলায় শল্কমোচন বেশি হয় ।

(গ) ক্ষুদ্রকণা বিশরণ (Granular disintegration):-  যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলির মধ্যে ক্ষুদ্রকণা বিশরণ হল অন্যতম একটি পদ্ধতি । যেসব শিলা বিভিন্ন রকমের খনিজ পদার্থে গঠিত, সেই সব বিষম গুণসম্পন্ন ও বড় দানা যুক্ত শিলাগুলি ঠান্ডায় বা গরমে সমান ভাবে সংকুচিত বা প্রসারিত হতে পারে না । এরফলে শিলাস্তরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন টানের সৃষ্টি হয় এবং তাতে শিলা সশব্দে ফেটে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় । মরু অঞ্চলে সাধারণত বিকেলের দিকে সূর্যাস্তের পরে এই শিলা ফাটার আওয়াজ পাওয়া যায় । উষ্ণতার তারতম্যের ফলে এইভাবে বিষম গুণসম্পন্ন শিলার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়াকে ক্ষুদ্রকণা বিশরণ বলে ।

(২) তুষারের দ্বারা সংঘটিত যান্ত্রিক আবহবিকার:

তুহিন খন্ডিকরণ বা তুষারের কাজ :- যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলির মধ্যে তুহিন খন্ডিকরণ বা তুষারের কাজ হল অন্যতম একটি পদ্ধতি । শীতল জলবায়ু অঞ্চলে, উচ্চ অক্ষাংশে বা উচ্চ পর্বতগাত্রে দিনের বেলায় বা গ্রীষ্মকালে বরফ গলে অথবা বর্ষাকালে শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যে জল সঞ্চিত হলে তা পরে শীতকালে বা রাত্রিবেলা অত্যধিক ঠান্ডায় জমে বরফে পরিণত হয় । জল বরফে পরিণত হলে আয়তনে শতকরা দশভাগ বৃদ্ধি পায় । এর ফলে ফাটলের মধ্যস্থিত জল বরফে পরিণত হয়ে ফাটলের দু’পাশের দেওয়ালে প্রচন্ড চাপের সৃষ্টি করে । এই চাপের ফলে ফাটল ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং শিলাস্তর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে পরিণত হয় । যান্ত্রিক আবহবিকারে এই বিশেষ প্রক্রিয়াটিকে তুহিন-খন্ডিকরণ বা তুষারের কাজ বলে ।

(৩) জল দ্বারা সংঘটিত যান্ত্রিক আবহবিকার:-

(ক) বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে বৃষ্টির জল কোমল পাললিক শিলা এবং ছিদ্রযুক্ত রূপয়ান্তরিত শিলার মধ্যে প্রবেশ করে এবং শিলাতরকে আর্দ্র করে তোলে । আর্দ্রতা বৃদ্ধির জন্য কালক্রমে শিলাস্তরটি খন্ডবিখন্ড হয়ে যায় ।

(খ) নদীর জল যখন দ্রুতগতিতে শিলাস্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন নদীর জলপ্রবাহের মধ্যবর্তী বায়ুর চাপের ফলে নদীপ্রবাহের নিম্নবর্তী শিলাস্তর ভেঙে খন্ডবিখন্ড হয়ে যায় ।

(৪) চাপ হ্রাসের ফলে সংঘটিত যান্ত্রিক আবহবিকার:- ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের শিলাস্তরে আবহবিকারের ফলে সৃষ্টি হওয়া এবং মূল শিলা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকা শিলাচূর্ণ গুলি কালক্রমে নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি শক্তিগুলি দ্বারা অপসারিত হলে শিলাস্তরের ওপরের অংশের চাপ কমে যায় । শিলাস্তরের ওপরের অংশের চাপ কমে যাওয়ার ফলে নীচের শিলাস্তরগুলি প্রসারিত হয় এবং শিলাস্তরের মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠের সমান্তরালে নানা আয়তনের ফাটল (Crack) সৃষ্টি হয় । এই সব ফাটলের প্রভাবে বড়ো বড়ো শিলার স্তরে বিচ্যুতি ঘটে । ক্রমশ ওই ফাটল বরাবর শিলাস্তর বিচ্ছিন্ন ও খন্ডবিখন্ড হয়ে যায় ।

*****

Comments

Related Items

কাবেরী নদী (The Kaveri)

কাবেরী নদী (The Kaveri) : কর্ণাটক রাজ্যের তালাকাভেরি উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে কাবেরী নদী কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মধ্য দিয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে । কাবেরী নদীর দৈর্ঘ্য ৭৬৫ কিমি.

কৃষ্ণা নদী (The Krishna)

কৃষ্ণা নদী (The Krishna) : পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মহাবালেশ্বরের শৃঙ্গের কিছুটা উত্তরে প্রায় ১৪০০ মিটার উচ্চতা থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর কৃষ্ণা নদী দক্ষিণ-পূর্বে তেলেঙ্গানা ও অন্ধপ্রদেশ রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিশাল বদ্বীপ সৃষ্টি করে

গোদাবরী নদী (The Godavari)

গোদাবরী নদী (The Godavari) : গোদাবরী নদী 'দক্ষিণ ভারতের গঙ্গা' নামে পরিচিত । মহারাষ্ট্রের ব্রম্ভগিরি পাহাড়ের ত্র্যম্বক শৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে এবং পরে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে গোদাবরী নদী মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ

মহানদী (The Mahanadi)

মহানদী (The Mahanadi) : ছত্তিসগড় রাজ্যের রায়পুর জেলার দক্ষিণাংশের সিয়াওয়া মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা রাজ্য অতিক্রম করার পর বদ্বীপ সৃষ্টি করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে । মহানদী

তাপী নদী (The Tapti)

তাপী বা তাপ্তি নদী (The Tapti) : মধ্যপ্রদেশের মহাদেব পর্বতের মুলতাই উচ্চভূমির প্রায় ৭৭০ মিটার উচ্চতা থেকে উৎপন্ন হয়ে তাপী নদী মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের ওপর দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে সাতপুরা ও অজন্তার মধ্যবর্তী সংকীর্ণ উপত