রুই মাছের অভিযোজন

Submitted by arpita pramanik on Mon, 12/24/2012 - 15:43

রুই মাছের অভিযোজন (Adaptation of Rohufish)

রুই মাছ মুখ্য জলজ প্রাণী । জলে বসবাস করার জন্য এদের দেহে নিম্নলিখিত অভিযোজনগুলি দেখা যায় । 

[1] দেহাকৃতি [Body contour]:- রুই মাছের দেহ বেম বা মাকুর মতো । দেহ দু'পাশ থেকে চ্যাপ্টা এবং দেহ থেকে কোনো প্রবর্ধক বেরিয়ে থাকে না । জলে সাঁতার কাটার সময় জলের গতি রোধ করার জন্য দেহের গঠন এই রকম হয়েছে ।

[২] দেহাবরণ [Body covering]:- রুই মাছে সারাদেহ সাইক্লয়েড আঁশ দিয়ে ঢাকা থাকে । আঁশের পিচ্ছিল আবরণ রুই মাছকে আত্মরক্ষার করতে এবং চলনের সময় ঘর্ষণজনিত বাধা দূর করতে সাহায্য করে ।

[3] পাখনা [Fins]:- পাখনা হল রুই মাছের প্রধান গমন অঙ্গ । রুই মাছের দেহে রশ্মিযুক্ত জোড়-সংখ্যক বক্ষ পাখনা ও শ্রোণি পাখনা এবং বিজোড়-সংখ্যক পৃষ্ঠ পাখনা, পায়ু পাখনা এবং পুচ্ছ পাখনা থাকে । পাখনাগুলি রশ্মিবিশিষ্ট হওয়ায় জলের চাপে ছিঁড়ে যায় না । এইসব পাখনাগুলি রুই মাছের চলন, গমন, দিক পরিবর্তন করতে এবং জলের মধ্যে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে ।

[4] পার্শ্ব বা স্পর্শেন্দ্রিয় রেখা [Lateral line] :- রুই মাছের দেহের দু'পাশে কানকোর পিছন থেকে লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত দুটি পার্শ্ব বা স্পর্শেন্দ্রিয় রেখা থাকে । স্পর্শেন্দ্রিয় রেখা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কাজ করে । এর সাহায্যে মাছ জলের চাপ, তাপ, গভীরতা, pH -মাত্রা বুঝতে পারে, জলের স্রোতের দিক নির্ণয় করতে পারে, শব্দ গ্রহন করতে এবং দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে ।

[5] বায়ুথলি বা পটকা [Air-bladder]:- রুই এবং অন্যান্য অস্থিবিশিষ্ট মাছদের উদরগহ্বরে মেরুদন্ডের নীচে অবস্থিত একটি বায়ুথলি বা পটকা থাকে । পটকা মাছের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমিয়ে বা বাড়িয়ে যথাক্রমে মাছকে জলের ওপরে ভাসতে বা জলের গভীরে নামতে অথবা জলের যে-কোনো স্থানে স্থিতিশীল থাকতে সাহয্য করে ।

[6] শ্বসন অঙ্গ [Respiratory Organ]:- রুই মাছের শ্বসন অঙ্গ হল ফুলকা [gills] । গলবিলের উভয় দিকে ফুলকা-গহ্বরের মধ্যে মাছের ফুলকা অবস্থিত । রুই মাছের ফুলকা, কানকো [operculum] দিয়ে ঢাকা থাকে । ফুলকাগুলোতে রক্তজালক থাকে । জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন ব্যাপন ক্রিয়ায় রক্তজালকের রক্তে প্রবেশ করে এবং একই প্রক্রিয়ায় জালক থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড [CO2] নির্গত হয় ।

[7] হৃৎপিন্ড [Heart]:- মাছেদের হৃৎপিন্ড হল ভেনাস অর্থাৎ হৃৎপিন্ডের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয় । এদের হৃৎপিন্ড একটি অলিন্দ ও একটি নিলয় নিয়ে গঠিত ।

[8] চোখ [Eye]:- রুই মাছের চোখ দুটি পল্লবহীন এবং গোলাকার । প্রতিটি চোখে একটি করে পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, যা জলের ঘর্ষণ থেকে চোখকে রক্ষা করে ।

[9] নাসারন্ধ্র [Nostrils]:- মাছের বহিঃনাসারন্ধ্র আছে, কিন্তু অন্তঃনাসারন্ধ্র থাকে না । নাসারন্ধ্র কেবল ঘ্রাণকার্যে সাহায্য করে ।

[10] মায়োটোম পেশি [Myotome muscles]:- রুই মাছের মেরুদন্ডের দু'পাশে 'V' আকৃতিবিশিষ্ট মায়োটোম পেশি থাকে । এই পেশির সংকোচনের মাধ্যমে রুই মাছ সাঁতার কাটার সময় মেরুদন্ডকে দেহের দু'পাশে আন্দোলিত করতে পারে ।

রুই মাছের অভিযোজনের বৈশিষ্ট্য ও অভিযোজনগত গুরুত্ব

জলজ পরিবেশে

অভিযোজিত অঙ্গ

বৈশিষ্ট্য অভিযোজনগত গুরুত্ব
১. পাখনা রুই মাছের দেহে রশ্মিযুক্ত জোড় সংখ্যক পাখনা (যেমন: বক্ষ পাখনা ও শ্রোণি পাখনা) এবং বিজোড় সংখ্যক পাখনা (যেমন: পৃষ্ঠ পাখনা, পায়ু পাখনা এবং পুচ্ছ পাখনা ) থাকে । পাখনা মাছের প্রধান গমন অঙ্গ । এইসব পাখনাগুলি রুই মাছের চলন, গমন, দিক পরিবর্তন করতে এবং জলের মধ্যে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে । পাখনাগুলি রশ্মিবিশিষ্ট ও দৃঢ় কাঠামোযুক্ত হওয়ায় জলের চাপে ছিঁড়ে যায় না ।
২. পটকা প্রত্যেক অস্থিযুক্ত মাছের মেরুদন্ডের নীচে উদর গহ্বরে একটি বায়ুপূর্ণ থলি বা পটকা থাকে । পটকা সাধারণত সামনের ও পিছনের প্রকোষ্ঠ দ্বারা গঠিত হয় । পটকার সামনের প্রকোষ্ঠে থাকা 'লালা গ্রন্থি' থেকে নির্গত গ্যাসে পটকা স্ফীত হলে মাছ জলে ভাসে, অপর দিকে পিছনের প্রকোষ্ঠে থাকা 'রেটিয়ামিরা-বিলিয়া' নামে রক্ত জালক ওই গ্যাস শোষণ করে নিলে মাছ জলে ডুবে যায় ।   পটকা মাছের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমিয়ে বা বাড়িয়ে যথাক্রমে মাছকে জলের ওপরে ভাসতে বা জলের গভীরে নামতে অথবা জলের যে-কোনো স্থানে স্থিতিশীল থাকতে সাহয্য করে, এই জন্য পটকাকে মাছের 'জলস্থিতি অঙ্গ' বলা হয় ।  
৩. ফুলকা ফুলকা হল মাছের শ্বসন অঙ্গ । দেহের উভয় পাশে ফুলকা গহ্বরের মধ্যে মাছের ফুলকা থাকে । অস্থিযুক্ত মাছের ফুলকা কানকো দিয়ে ঢাকা থাকে । ফুলকা রক্তজালকপূর্ণ হওয়ায় জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন (O2) ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুলকার রক্ত জালকে প্রবেশ করে এবং ওই একই প্রক্রিয়ায় ফুলকার রক্ত জালক থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) গ্যাস জলে নির্গত হয় । ফুলকার সাহায্যে এইভাবে জলে ডুবন্ত অবস্থাতেও মাছের শ্বাসকার্য চলে ।
৪. দেহাকৃতি জলে বাস করার সুবিধার জন্য রুই মাছের দেহাকৃতি বেম বা মাকুর মতো হয়েছে, যা মাছকে জলের বাধা অতিক্রম করে দ্রুত সাঁতার কাটতে সাহায্য করে । মাকুর মতো দেহের আকার এবং দেহের পার্শ্বদেশ চ্যাপ্টা হওয়ায় মাছ জলের মধ্যে দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে পারে ।
৫. চোখ রুই মাছের মাথার দু'পাশে একটি করে মোট দুটি পল্লবহীন চোখ  আছে । এছাড়া প্রতিটি চোখ নিকটিটেটিং পর্দা নামে এক ধরনের পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে ।            পাতাবিহীন চোখের সাহায্যে মাছ সহজেই জলের মধ্যে দেখতে পায় । প্রতিটি চোখ নিকটিটেটিং পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকায় মাছের চোখগুলো জলের ঘর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায় ।           

*****

Related Items

ছত্রাক (Fungi)

ক্লোরোফিলবিহীন পরভোজী পুষ্টিসম্পন্ন ও ইউক্যারিওটিক প্রকৃতির সমাঙ্গদেহী উদ্ভিদদের ছত্রাক বলা হয় । ছত্রাকের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম । মানবজীবনে ছত্রাকের উপকারিতা ও অপকারিতা । পেনিসিলিয়াম, ঈস্ট প্রভৃতি উপকারী ছত্রাক । পেনিসিলিয়াম এক রকমের বহুকোশী মৃতজীবী ...

জীবাণু বা মাইক্রোবস (Microbes)

যে সমস্ত অতি ক্ষুদ্র এবং এককোশী বা বহুকোশী জীবদের খালি চোখে দেখা যায় না অথচ কেবলমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায়, তাদেরই সাধারণভাবে জীবাণু বলে । অতিক্ষুদ্র ও আণুবীক্ষণিক জীবদের এককথায় জীবাণু বা অণুজীব বা মাইক্রোবস বলা হয় ।

রোগসৃষ্টিকারী ভাইরাসের রোগ সংক্রমণ প্রক্রিয়া

ভাইরাস বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে, যেমন - ইনফ্লুয়েঞ্জা, AIDS, পোলিও, জল বসন্ত, মাম্পস, হাম, এনকেফালাইটিস, জলাতঙ্ক, পা ও মুখের ঘা, জন্ডিস, ডেঙ্গু জ্বর প্রভৃতি । ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রধানত মানুষের শ্বসনতন্ত্রকে আক্রমণ করে, ফলে রোগীর হাঁচি, কাশি ও নির্গত মিউকাসের মাধ্যমে ...

ব্যাকটিরিয়া আক্রমণকারী ভাইরাস বা ব্যাকটিরিওফাজ

1917 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী দ্য হেরেলী ব্যাকটিরিয়া আক্রমণকারী ভাইরাসদের ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস বা ব্যাকটিরিওফাজ বা ফাজ নামে অভিহিত করেন । এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাকটিরিওফাজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ভালো করে জানা গিয়েছে, তাদের মধ্যে 'T' শ্রেণির অন্তর্গত ব্যাকটিরিওফাজই প্রধান । ...

ভাইরাসে জড়ের ও প্রাণের লক্ষণ

ভাইরাসের দেহে সাইটোপ্লাজম থাকে না । ভাইরাস কোনো বহিঃস্থ উদ্দীপকে সাড়া দেয় না । ভাইরাসের চলন ক্ষমতা নেই । ভাইরাসের দেহে কোনোরকম বিপাক ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না । পোষকের দেহ-কোশে ভাইরাস বংশবিস্তারে সক্ষম । ভাইরাসের দেহে প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিডের ...