প্রাচীন ভারতের শিল্প ও চিত্রকলা

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 04/18/2012 - 10:39

প্রাচীন ভারতের শিল্প ও চিত্রকলা :

(১) মৌর্য যুগ : মৌর্যযুগে অশোকের সময় থেকে ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন পরিলক্ষিত হয় । অশোকের নির্মিত স্থম্ভগুলি, বিশেষত সারনাথের স্থম্ভ উন্নত শিল্পশৈলী ও কারিগরি বিদ্যার নিদর্শন । মৌর্য যুগে স্থাপত্যের নিদর্শন অবশ্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয় । অশোক সারা ভারতে স্তম্ভ ও প্রায় ৮৪,০০০টি মন্ডপ নির্মাণ করেছিলেন । এই মন্ডপগুলির মধ্যে সচেয়ে উল্লেখ যোগ্য হল সাঁচি স্তূপ

(২) মৌর্যোত্তর যুগ : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শুরু পর্যন্ত সময়ে ভারতীয় শিল্পরীতিতে কয়েকটি বিশেষ ধারার উদ্ভব ঘটেছিল । এর মধ্য উত্তর ভারতে ভারহুত, বুদ্ধগয়া, মথুরাগান্ধার শিল্পরীতি এবং দক্ষিণ ভারতে অমরাবতী নাগার্জুনিকোন্ড শিল্পরীতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য । এগুলির মধ্য তক্ষশিলা, আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা গান্ধার শিল্প শিল্পরসিক ও সমালোচকদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । গান্ধার শিল্পের নিদর্শন হিসাবে যে সব বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে, তাদের দৈহিক গঠন একেবারে নিখুত । এখানে গ্রিক-রোমান শিল্পরীতির প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু তার আদর্শ ও সত্তা ছিল পুরোপুরি ভারতীয় । এইজন্য গান্ধার শিল্প সম্পর্কে বলা হয় যে, শিল্পীর হাত ছিল গ্রিকের, কিন্তু হৃদয় ছিল ভারতীয় । অন্যদিকে মথুরায় যে শিল্পরীতি গড়ে উঠেছিল, তা সম্পূর্ণরূপে বিদেশি প্রভাব মুক্ত । এই সময় কালেও ভাস্কর্যের নিদর্শনের পাশে স্থাপত্যের নিদর্শন অনেকাংশে ম্লান । এই সময়ে নির্মিত গুহা ও চৈত্যগুলি আকর্ষনীয় । নাসিক, কার্লে প্রভৃতির চৈত্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।

(৩) গুপ্তযুগে শিল্পকলা : স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ইতিহাসে গুপ্তযুগকে স্বর্ণযুগ বলে আখ্যা দেওয়া হয় । অজন্তা ইলোরা -র গুহা-মন্দিরগুলির নির্মাণশৈলীর মধ্যে গুপ্ত স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় । এই সময়কার অনেক মন্দিরই ধ্বংস হয়ে গেছে । সাঁচি দেওঘরে পাথরের তৈরি মন্দিরগুলি আকারে ছোটো । কিন্তু সৌন্দর্য ও নির্মাণশৈলীর বিচারে অসাধারণ । ভিতরগাঁও –এর ইটের তৈরি মন্দিরটি আকারে বড় । এই মন্দিরটিও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে । হিন্দু ও বৌদ্ধ দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণে গুপ্ত ভাস্কর্যের পরিচয় পাওয়া যায় । বহু বৌদ্ধমূর্তি সারনাথ থেকে পাওয়া গেছে । মথুরা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকেও পাথর এবং ব্রোঞ্জের বহু বুদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে । শিব, বিষ্ণু এবং অন্যান্য হিন্দু দেবতার মূর্তি দেওঘর মন্দিরের গায়ে খোদিত অবস্থায় পাওয়া গেছে । অজন্তার গুহা চিত্রগুলি গুপ্ত চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন । অজন্তার গুহা চিত্রগুলির মধ্যে গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে । বাঘ গুহার চিত্রগুলিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।

চূড়া ও শিখরের আকৃতির বিচারে গুপ্ত যুগের পর থেকে প্রাচীন যুগের শেষ পর্যন্ত সময়ের শিল্পরীতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে— (ক) ইন্দো-এরিয়ান বা উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতি এবং (খ) দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়ীয় শিল্পরীতি ।

(ক) ইন্দো-এরিয়ান বা উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতি : উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতির নিদর্শন হল ভুবনেশ্বর, পুরী, খাজুরাহো, দিলওয়াড়া, মার্তন্ড, কোনারক, ইত্যাদি ।

(খ) দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়ীয় শিল্পরীতি :

(১) পল্লব শিল্প : দক্ষিণ ভারতের শিল্পকলার শিল্পরীতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে পল্লব শিল্পে অলংকারের প্রাচুর্য নেই । কিন্তু সূক্ষ শিল্পের কাজে ও সৌন্দর্যের বিচারে পল্লব শিল্প অতুলনীয় । মূলত ধর্মীয় বিষয়ের ওপর গড়ে ওঠা পল্লব শিল্পকে চার ভাগে ভাগ করা যায় ।  

(ক) মহেন্দ্র শিল্পরীতি : যেগুলি পাহাড় কেটে গুহা-মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে ।

(খ) মামল্ল শিল্পরীতি : যেগুলি পাহাড় কেটে রথাকৃতি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে ।

(গ) রাজসিংহ শিল্পরীতি : যেগুলি পাথরের স্বতন্ত্র মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে ।

(ঘ) নন্দীবর্মন শিল্পরীতি : নন্দীবর্মন গোষ্ঠীর শিল্পরীতির উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল মুক্তেশ্বর ও মাতঙ্গেশ্বর মন্দির ।   

মহাবলী পুরম বা মামল্লপুরমের রথগুলি পল্লব শিল্পের অন্তর্গত মামল্ল শিল্পরীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ । একাম্বরনাথ মন্দির অনন্তশয়ন মন্দির মহেন্দ্র শিল্পরীতির স্বাক্ষর বহন করে । এইসব রথে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অপূর্ব মিলন ঘটেছে । 

(২) চোল শিল্পরীতি : দ্রাবিড় শিল্পরীতির চরমতম বিকাশ ঘটেছিল চোল আমলে । কাঞ্চিপুরমের কৈলাসমন্দির, গঙ্গৈকোন্ড-চোলপুরমের মন্দির এবং তাঞ্জোরের বৃহদেশ্বর মন্দির হল চোল শিল্পের প্রধান নিদর্শন । পাথরের তৈরি স্বাধীন মন্দির যেগুলি পাহাড় কেটে তৈরি নয়, বৃহৎ তোরণ, মন্দির গাত্রে খোদাই করা অসংখ্য মূর্তি হল চোল শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য ।

(৩) চালুক্য শিল্পরীতি : দক্ষিণ ভারতে 'চালুক্য রীতি' নামে আর একটি শিল্পরীতি প্রচলিত ছিল । চালুক্য যুগে হিন্দু মন্দিরগুলি অনেক সময় জৈন মন্দির ও বৌদ্ধ মঠের অনুকরণে তৈরি হত । চালুক্য রীতির উদাহরণ হল বাতাপির বিষ্ণুমন্দির, আইহোলের বিষ্ণুমন্দির, পট্টৎকলের পাপনাথ বিরূপাক্ষ মন্দির, বোম্বাইয়ের এলিফ্যান্টা মন্দির । রাষ্ট্রকুট আমলে চালুক্য রীতির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল । ইলোরার বিখ্যাত কৈলাস মন্দির রাষ্ট্রকুট শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ।

*****

Related Items

ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কারণ ও তার ফলাফল

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে একটি বড়ো কারণ ছিল পুঁজির জোগান । এই পুঁজির অনেকটাই এসেছিল ঔপনিবেশিক ব্যবসাবাণিজ্য থেকে । ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে দুটি সমস্যা দেখা দেয় ...

ইউরোপীয় ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি

ভারত ইতিহাসে ইংরেজ শাসনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার । কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মানদণ্ড অচিরেই রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল । আগে যেসব বহিরাগত জাতি ভারতে এসেছিল, তাদের সঙ্গে ...

দেওয়ানি লাভ ও দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব

বক্সারের যুদ্ধে ত্রিশক্তির পরাজয়ের পর প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে ইংরেজদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । এই অবস্থায় ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে বাংলায় ক্লাইভের পুনরাগমন ঘটে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের এলাহাবাদ চুক্তিতে ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কারা ও এলাহাবাদ ছাড়া ...

বক্সারের যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব

কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুটি, মুঙ্গের ও উদয়নালায় পরপর ছয়টি যুদ্ধে মিরকাশিম পরাজিত হন । এই অবস্থায় ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মিরকাশিমকে সিংহাসনচ্যুত করে ইংরেজরা মিরজাফরকে আবার বাংলার মসনদে বসান । কিন্তু মিরকাশিম হাল না ছেড়ে মুঘল সম্রাট শাহ আলম ...

মির কাশিম (Mir Kasim)

কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ এবং বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টোগ্রামের জমিদারি প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মিরকাশিম বাংলার মসনদ লাভ করেন । ইংরেজদের সাহায্যে বাংলার মসনদ দখল করলেও তিনি ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ ছিলেন না, বরং বাস্তববাদী ছিলেন । অহেতুক ইংরেজ বিরোধিতা তাঁর ...