দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to the Accession of Princely State with India):-
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নাম দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । স্বাধীনতা লাভের আগে বা দেশভাগের আগে পর্যন্ত ভারতীয় ভুখন্ডে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনাঞ্চল ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটোবড়ো মিলিয়ে ছয় শতাধিক দেশীয় রাজ্য অবস্থিত ছিল । এই সমস্ত দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ সরকারের সার্বভৌমত্বের অধীনে স্বশাসনের অধিকার ভোগ করত । ছোটো-বড়ো প্রায় ৫৬টি রাজ্যের অধীনে ছিল মোট ভারতীয় ভূখণ্ডের শতকরা ৪০ ভাগ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত দেশীয় রাজ্যগুলির সমষ্টিগত আয়তন ছিল সমগ্র ভারতীয় ভূখণ্ডের ৪০ ভাগ । এই সময়ে ভারতের মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৯ কোটি, যার মধ্যে দেশীয় রাজ্যগুলির জনসংখ্যা ছিল ৯ কোটি । স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই সমস্ত রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয় ।
স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই, মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি -র প্রেরিত 'মন্ত্রী মিশন' বা 'ক্যাবিনেট মিশন' ঘোষণা করে যে, (i) ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটবে । (ii) স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ-শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি 'ভারতীয় ইউনিয়ন' গঠন করা হবে । (iii) বিদেশনীতি নির্ধারণ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপরে এই ভারতীয় ইউনিয়ন সরকারের কর্তৃত্ব বজায় থাকবে এবং অন্যান্য বিষয়ে দেশীয় রাজাগুলিতে নিজ নিজ শাসকদের অধিকার বজায় থাকবে ।
দেশীয় রাজ্যের রাজাগণ ক্যাবিনেট মিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে দাবি জানিয়ে বলেন যে, (i) প্রস্তাবিত ভারত ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে দেশীয় রাজাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকবে । (ii) দেশীয় রাজারা তাদের হারানো ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ফিরে পাবেন । (iii) প্রতিটি দেশীয় রাজ্যের শাসনতন্ত্র, ভৌমিক অখন্ডতা এবং রাজবংশের উত্তরাধিকার বিষয়ক আইন কানুনগুলি বজায় থাকবে ।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪র্থ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া 'ভারতীয় স্বাধীনতা আইন' -এ বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে । দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার অথবা ভারত বা পাকিস্তানের যে-কোনো একটি রাষ্ট্রে যোগদানের অধিকার দেওয়া হয় । এই আইন ঘোষিত হওয়ার সময় ইংল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেল হার্টলে শক্রস্ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি বলেন যে, দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার জন্য দেশীয় রাজ্যগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে ও মহাদেশের অশান্তি বাড়বে । এ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তান উভই দেশেরই ভৌগলিক সংহতি বিঘ্নিত হবে এবং উভয় দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়বে । তাই দেশীয় রাজ্যগুলির উচিত হবে ভারত বা পাকিস্তান যে-কোনো একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদেরকে সংযুক্ত করা ।
ভারতীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতের অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত কোনো দেশীয় রাজ্য পাকিস্তানে যোগ দিলে বা স্বাধীন থাকলে তা স্বাধীন ভারতের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হবে । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করে যে, ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব ভারত স্বীকার করবে না । দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগকে সফল করার জন্য কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল -এর দায়িত্বে 'দেশীয় রাজ্য দপ্তর' নামে এক দপ্তর গঠন করা হয় । এই দপ্তরের মাধ্যমে ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বলিষ্ঠ কূটনীতি ও সামরিক শক্তি উভয়ের প্রয়োগ ঘটিয়ে দুই পর্যায়ে প্রায় একশোর ওপর দেশীয় রাজ্যকে ভারতভুক্ত করেন । প্রথমে তিনি দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন । পরে তিনি কঠোর সামরিক নীতি প্রয়োগের হুমকি দেয় । সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কঠোর ভাষায় বলেন, দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতরাষ্ট্রে যোগ না দিলে একদিকে যেমন তারা তাদের নিজেদের প্রজাদের রোষের মুখোমুখি হবে, অপরদিকে তেমনি ভারতের সামরিক শক্তিও চুপ করে থাকবে না । সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ভি পি মেনন -এর কুটকৌশল এবং মাউন্টব্যাটেনের সহযোগিতায় ভারতের সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণে সফল হন । ভারত স্বাধীন হওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রায় সমস্ত দেশীয় রাজ্য ভাতা, খেতাব ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে 'ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেসান' (Instrument of Accession) -নামে ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে ভারতরাষ্ট্রে যোগ দেয় ।
দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় । (i) ভারত রাষ্ট্রের প্রদেশগুলির সঙ্গে তার সন্নিহিত দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তি করা হয় । যেমন— উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সংযুক্তি, উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে গাড়োয়াল, রামপুর ও বেনারসের সংযুক্তি, পাঞ্জাবের সন্নিহিত দেশীয় রাজ্যগুলিকে পাঞ্জাবের সঙ্গে, মাদ্রাজের দেশীয় রাজ্যগুলিকে মাদ্রাজের সঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোচবিহারকে, খাসি পার্বত্য দেশীয় রাজ্যগুলিকে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় । (ii) কয়েকটি দেশীয় রাজ্যকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে একটি বৃহৎ রাজ্যে রূপান্তর করা হয় । যেমন— রাজস্থান, মধ্যভারত, সৌরাষ্ট্র, ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন ও পেপসু (PEPSU) বা Patiala and East Punjab States Union । (iii) কয়েকটি দেশীয় রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় । যেমন— হিমাচল প্রদেশ, কচ্ছ, বিলাসপুর, ভোপাল, ত্রিপুরা ও মনিপুর ইত্যাদি । এইভাবে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারির মধ্যে ২১৬টি দেশীয় রাজ্যকে তাদের সন্নিহিত প্রদেশগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় ও ২৭৫টি দেশীয় রাজ্য পাঁচটি রাজ্যে রূপান্তরিত হয় এবং ৬১টি দেশীয় রাজ্যকে ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় ।
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রায় সমস্ত দেশীয় রাজ্য ভারতরাষ্ট্রে যোগদান করলেও জুনাগড়, জম্মু-কাশ্মীর এবং হায়দ্রাবাদ স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষায় অনড় থাকে । এই তিনটি দেশীয় রাজ্যকে ভারতভুক্ত করার ক্ষেত্রে সমস্যা ও বিতর্ক দেখা দেয় । ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল -এর মধ্যে বিতর্ক বাধে । সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল চেয়েছিলেন জুনাগর ও হায়দ্রাবাদের ভারতভুক্তি হোক কিন্তু কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি না হলেও চলবে । জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছা ছিল কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হোক । কাশ্মীর নিয়ে জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছাকে বল্লভভাই প্যাটেল সম্মান দেন । অবশেষে এই তিনটি দেশীয় রাজ্যকে ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয় । কাশ্মীরকে ভারতভুক্তির সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ বাধে । এই সমস্যা সমাধানের জন্য নেহরু সরকার জাতিপুঞ্জে সমস্যার কথা উত্থাপন করলে বির্তকের সৃষ্টি হয় ।
দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে যোগ দিলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশকিছু ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশ রয়ে যায় । এগুলির মধ্যে বাংলার চন্দননগর, মাদ্রাজের পণ্ডিচেরি, পশ্চিম উপকূলে মাহে ইত্যাদি ফরাসি উপনিবেশ এবং গোয়া, দমন ও দিউ, দাদরা-নগরহাভেলি ইত্যাদি পোর্তুগিজদের উপনিবেশ প্রধান ছিল । এই উপনিবেশগুলির জনগণ স্বাধীনতা লাভের জন্য স্বাধীন ভারতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে । ফরাসি সরকার তাদের উপনিবেশগুলি স্বাধীন ভারতের হাতে তুলে দিলেও পোর্তুগিজ সরকার ইংল্যান্ড ও আমেরিকার গোপন মদতে তাদের উপনিবেশগুলি স্বাধীন ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়নি । শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীর সাহায্যে ভারত সরকার গোয়া ও পোর্তুগিজ অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলগুলির দখল নেয় । এইভাবে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয় ।
*****