সভা সমিতির যুগ : বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ :- (Age of Associations)
ঊনিশ শতকের প্রথম থেকে ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে একের পর এক আদিবাসী ও কৃষক আন্দোলন এবং মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে । ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রসার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর দ্রুত ঘটতে থাকে । উনবিংশ শতকে ব্রিটিশদের উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষ শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে । মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় উপলব্ধি করে যে ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা সম্ভব নয় । এর একমাত্র উপায় হল ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলন করা । ব্রিটিশদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার । এই উদ্দেশ্য ঊনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা সভাসমিতি গড়ে উঠতে থাকে । এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—(i) বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, (ii) জমিদার সভা, (iii) ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, (iv) হিন্দু মেলা, (v) ভারতসভা, (vi) জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি । এই সমস্ত রাজনৈতিক সভাসমিতি ও সংগঠন ব্রিটিশ-বিরোধী জনমত গঠনে সহায়ক হয়ে ওঠতে থাকে । এই জন্য কেমব্রিজ গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ড. অনিল শীল ঊনিশ শতককে 'সভাসমিতির যুগ' বলে অভিহিত করেছেন ।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ভারতীয়রা সংঘবদ্ধ ছিল না । ভারতীয় শাসকশ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের পথ সুগম করেছিল । সংকীর্ণ স্বার্থে মারাঠা, শিখ সবাই মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ করেছে । সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে তখন কোন ভূমিকা গ্রহণ করত না । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতের রাজশাসনের অবলুপ্তি ঘটিয়ে দেশীয় রাজা ও নবাবদের কার্যত নিজেদের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসেন । এই সময় ভারতীয় সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এবং দুটি বিশিষ্ট শ্রেণির মানুষের উদ্ভব হয় । প্রথমত, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় চিরস্থায়ী জমিদারি ব্যবস্থার প্রবর্তনের হলে এক নতুন ধরনের ভূস্বামী সম্প্রদায়ের জন্ম হয় । এই ধরণের জমিদাররা প্রথমদিকে তাদের জমি হারায়, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যাতে জমিদারদের আয় বাড়ে, সেদিকে নজর দিলে কৃষকশ্রেণি সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয় । পরের দিকে আবার যখন ব্রিটিশ সরকার কৃষকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করলেন, তখন জমিদাররা সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয় । দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটল, যারা চাকরি করার পাশাপাশি আইনব্যবসা, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, চিকিৎসা ইত্যাদি বিভিন্ন গঠনমূলক পেশায় নিযুক্ত হল ।
এই দুই শ্রেণির মানুষ ব্রিটিশ শাসনে অসন্তুষ্ট ছিলেন । তারা তাদের চিন্তাভাবনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের পথ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন । ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোয় ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ না থাকায় ভারতীয়রা নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলার দিকে নজর দেয় । এই ভাবেই শুরু হয় সভাসমিতির যুগ । জমিদার শ্রেণি মহাবিদ্রোহের বেশ কিছুটা আগে থেকেই তাদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলেছিল । মহাবিদ্রোহের পরবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলি মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সক্রিয় প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল । এই সময়ে ভারতের বাইরেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে । এইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ভারতের জনমত গড়ে উঠতে থাকে । সভাসমিতিগুলি প্রধানত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগঠন হওয়ায় এবং সমাজের ওপরতলার মানুষেরা এইসব সভাসমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তারা এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের দাবিদাওয়া তুলে ধরেছিল । সাধারণ দরিদ্র শ্রমিক-কৃষকশ্রেণির সঙ্গে তাদের তেমন সম্পর্ক ছিল না । ফলে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবিদাওয়া এইসব সভাসমিতির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়নি । অবশ্য এইসব সভাসমিতিগুলি জাতি ও ধর্মের সংকীর্ণ সীমারেখা অতিক্রম করে গড়ে উঠেছিল এবং কলকাতা, বোম্বাই (মুম্বাই), মাদ্রাজ (চেন্নাই) পুনা (পুনে) প্রভৃতি বড় বড় শহরকে কেন্দ্র করে এইসব সভাসমিতি গড়ে ওঠে । শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলনের মধ্যে যে এক অবাস্তব আবেগধর্মী দিক ছিল তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি' থেকে জানা যায় ।
*****