উনিশ শতকে প্রচলিত হিন্দুধর্ম এক সংকটের সম্মুখীন হয় । পৌত্তলিকতা, বহু দেবতার আরাধনা প্রভৃতি বিষয়ে প্রচলিত হিন্দুধর্মে নানান বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল । এসবের বিরুদ্ধে উনিশ শতকের বাংলায় রাজা রামমোহন রায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীদের উদ্যোগে হিন্দু ধর্মের সংস্কারকার্য শুরু হয় । হিন্দু ধর্মের সংকটের কারণ মোটামুটি দুটি । প্রথমত, প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও সমাজে প্রচলিত কুপ্রথার ফলে হিন্দুধর্মের মধ্যে অনৈক্য প্রকট হয়ে উঠে । জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ হিন্দুধর্মে অনেকেই আস্থা হারিয়ে ফেলে । রক্ষনশীল ও গোঁড়া হিন্দু নেতারা সংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল । দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টান মিশনারিদের লাগাতার প্রচারের ফলে বহু মানুষ খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল । মিশনারিরা প্রাচলত হিন্দুধর্মকে কঠোরভাবে আক্রমণ করতে শুরু করে । সমাজের ওপর তলার কিছু মানুষও তাদের প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে প্রচলিত হিন্দুধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন । ফলে হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছিল ।
এইসব আক্রমণের হাত থেকে প্রচলিত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্য রামমোহন রায়কে এই কাজে ব্রতী হতে গিয়ে ঘরে-বাইরে উভয় দিক থেকেই প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হতে হয় । বাংলায় কিছু রক্ষণশীল ও কট্টর নেতা সর্বপ্রকার সংস্কারের বিরোধী ছিলেন । পৌত্তলিকতা ও একেশ্বরবাদী নিয়ে রামমোহনের সাথে গোঁড়া হিন্দুদের তীব্র তর্কবিতর্ক হয় । সুব্রহ্মণ্য স্বামী, রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার প্রমূখ হিন্দু সমাজের নেতাদের সঙ্গে তাঁর তীব্র মতবিরোধ ছিল । খ্রিস্টান মিশনারিরা রামমোহনের প্রচলিত হিন্দুধর্মের বিরোধিতায় উল্লসিত হয়ে আশা করেছিল যে, তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবেন । কিন্তু তিনি তাদের এই আশাকে নিরাশায় পরিণত করে মিশনারিদের সঙ্গেও তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন । গোঁড়া হিন্দু নেতাদের আচরণ তাঁকে ব্যথিত করলেও তিনি প্রচলিত হিন্দুধর্ম ত্যাগ করা বা নতুন কোন ধর্ম প্রচার করার কথা ভাবেননি । খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে শাশ্বত প্রচলিত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা ও বাংলায় বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই হল রামমোহনের সবচেয়ে বড় অবদান । গোঁড়া হিন্দুধর্মের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন । রামমোহন রায়ের পর ব্রাহ্মসমাজ বাংলার ধর্মসংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।
উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই আন্দোলন মূলত সমাজের ওপর তলার শিক্ষিত ও ভদ্রলোক শ্রেণির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । শিক্ষিত ও উচ্চবর্ণের মানুষেরাই ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল । সাধারণ অশিক্ষিত ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে এই আন্দোলনের মর্ম বোঝা কঠিন ছিল । ধর্মীয় যুক্তিতর্কের জটিলতা নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না । সেই তুলনায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মাটির অনেক কাছাকাছি ছিলেন ও তাঁর আবেদন সমাজের সবরকম মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল । উনিশ শতকের প্রথমার্ধের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুধর্মের সংস্কার এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের হিন্দুধর্মবিরোধী প্রচার থেকে প্রচলিত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা । ব্রাহ্মসমাজও প্রচলিত হিন্দুধর্মের সংস্কার চেয়েছিল । কিন্তু নব্যহিন্দু আন্দোলন হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের ওপর যতটা জোর দিয়েছিল, সংস্কারের দিকে ততটা নয় । উনিশ শতকের বাংলায় প্রচলিত হিন্দুধর্ম তার পুরোনো মর্যাদা ও গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল ।
*****