Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 06/19/2020 - 11:26

ভূমিকা :- "এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ 

                      তবু রঙ্গে ভরা"— ঈশ্বর গুপ্ত

উৎসব হল মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ । মানুষ শুধু খেয়ে-পরে বেঁচেই সন্তুষ্ট থাকে না । সে অনেকের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে চায় । মানুষ দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিক একঘেয়েমির জীবন থেকে মুক্তি চায় । শ্রমক্লান্ত জীবনে পেতে চায় সহজ অনাবিল আনন্দ । আর তাই মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে । উৎসব মানুষকে আনন্দ দেয়, প্রসারিত করে তার অস্তিত্বকে । বাঙালির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের মেঘ বারবার ঘনিয়েছে । কখনও দুর্ভিক্ষ, মহামারী মেতেছে বীভৎস মারণ যজ্ঞে । কখনও রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে স্থান থেকে স্থানান্তরে । তবুও আনন্দস্রোতে ভাটা পড়েনি, কারণ বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি । আমার আনন্দে সবার আনন্দ হউক, আমার সুখে সবাই সুখী হউক, এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ ।

উৎসবের শ্রেণীবিভাগ :-এই উৎসবকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়— (ক) ঋতু উৎসব,  (খ) ধর্মীয় উৎসব,  (গ) সামাজিক-পারিবারিক উৎসব ও   (ঘ) জাতীয় উৎসব ।

(ক) ঋতু উৎসব :- বিশেষ বিশেষ ঋতুর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাঙালিরা মেতে ওঠে নানান বর্ণময় ঋতু উৎসবে । বছরের শুরুতে নানা রকমভাবে নববর্ষ উদযাপন হয় । নবান্ন ও পৌষপার্বণ দুটি উৎসব নতুন ফসল কাটার সময় হয় । শীত ঋতুতে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা রকম পিঠেপুলি ও মিষ্টান্ন তৈরি হয় । দোলযাত্রা হয় বসন্ত ঋতুকে কেন্দ্র করে । রঙের উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব, বর্ষামঙ্গল, বসন্ত উৎসব -এর প্রচলন করেন, যা আজ বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ।

(খ) ধর্মীয় উৎসব :- নানান ধর্মসম্প্রদায়ের বাস এই বাংলায় । বাঙালি জাতি নানারকম ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী । তাই ধর্মকেন্দ্রিক নানান উৎসবের আয়োজন চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে । হিন্দুদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা । এছাড়া কালীপুজা, সরস্বতী পুজা, লক্ষ্মী পুজা, বিশকর্মা পূজার আয়োজন করা হয় । মুসলমানদের ঈদ, মহরম, শবেবরাত কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে পালিত হয় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে । ধর্ম আলাদা হলেও বাঙালিরা কিন্তু একে অন্যের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করে, একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করে ।

(গ) সামাজিক-পারিবারিক উৎসব:-  মানুষ সামাজিক জীব । বেশ কিছু উৎসব আছে যেগুলিতে পরিবারের কোনো আনন্দ অথবা দুঃখের অনুভূতিকে সমাজের আর পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায় । বিবাহ, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, উপনয়ন, জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা— এই সকল পরিবারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর মিলনানুষ্ঠানে পরিণত হয় । এই সকল অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক মনোমালিন্য যেমন দূর হয়, তেমনি দূরের আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় ।

(ঘ) জাতীয় উৎসব :- আমরা যে রাষ্ট্রে বাস করি সেই ভারতবর্ষে বিভিন্ন মনিষীদের জন্মদিবস, যেমন— নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের জন্মদিন, রবীন্দ্রজয়ন্তী, মহাত্মা গান্ধির জন্মদিন, নজরুলজয়ন্তী, যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন এবং বিশেষ কিছু দিন যেমন— স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসও সারা ভারতবাসী তথা বাঙালিরা যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করে থাকে ও উৎসবে মেতে উঠে ।

উপসংহার :- যতই কৃত্রিমতা চেপে বসুক না- কেন বাঙালি আজও উৎসবমুখর থাকতেই ভালোবাসে । তাই আজ নতুন প্রজন্ম অনেক হারিয়ে যাওয়া উৎসব নতুন করে পালন করছে । লাইট, প্যান্ডেল, প্রতিমা নির্মাণে যে প্রতিযোগিতা চলে তার মধ্যেও বাঙালির শিল্পভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় । কর্মব্যস্ত মানুষও আজকাল উৎসবের দিনগুলিতে কাজ থেকে দূরে থাকতে চায় । ফিরে আসতে চায় নিজভূমিতে । তাই অদূর ভবিষ্যতে বাঙালির উৎসব প্রাণের উৎসব হয়ে উঠবে এই প্রত্যয় জাগে ।

***

Comments

Related Items

ছাত্র জীবনে খেলাধূলার প্রয়োজনীয়তা

'ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ' । ছাত্রছাত্রীদের প্রধান কাজ হল পড়াশুনা করা । পড়াশুনাকে তপস্যার মতো করেই করা দরকার ।

বিশ্বের ত্রাস মহামারী করোনা

ভুমিকা:- একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার শিখরে বাস করেও মানুষ ভয়ঙ্কর এক মহামারির মোকাবিলা করতে পারেনি । সেই মহামারি হল করোনা । ধনী বা দরিদ্র কোন দেশই করোনা নামক মহামারির কবল থেকে রেহাই পায়নি । করোনা এমনই এক রোগ যা অতি দ্রুত মানুষকে সংক্রমিত করে । এটা নতুন রো

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্প

"বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি । / দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী — / মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, / কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু / রয়ে গেল অগোচরে । বিশাল বিশ্বের আয়োজন ; / মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ ।" — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

যুগে যুগে বাংলার বুকে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে অন্যতম । ঈশ্বরচন্দ্রের পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মনিষ্ঠা, নির্ভীকতা, হৃদয়বত্তা মানবসমাজে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত । হিমালয়ের মতো বিশাল ও উন্নত মনের মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর ছিলেন না, করুণার সিন্ধুও ছিলেন ।

রক্তদান — মানবকল্যাণের আর এক নাম

"দেহের একটু রক্ত দিলে যদি বাঁচে একটি প্রাণ, / ধন্য হবে জনন তোমার, মহৎ তোমার দান । "