ভূমিকা :– 'মেলা' কথাটির মধ্যে আছে মিলনের ইঙ্গিত । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমরা গিয়ে এক জায়গায় মিলিত হই । সম্মিলিত মানুষের সমাবেশেকেই মেলা বলে । প্রত্যেক মেলার একটা উপলক্ষ থাকে ঠিকই, কিন্তু একসময় সেটা একেবারেই গৌণ হয়ে যায় । লক্ষ্য হয়ে ওঠে পরস্পরের মধ্যে মিলেমিশে কিছু দেওয়া-নেওয়া বা আদান-প্রদান । মেলা হল মিলনের ক্ষেত্রে । মিলনের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় ।
নানারকমের মেলা:– সারা বছর ধরে কোনো না কোনো জায়গায় মেলা হয়ে চলেছে । মেলার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় থাকে না । কখনো চৈত্র সংক্রান্তির বিকেলে, কখনো আষাঢ়ের বৃষ্টি ভেজা দিনে । শীতের সকালেও বসে পৌষ সংক্রান্তির মেলা । নানারকম বিষয়কে কেন্দ্র করে মেলা বসে । (১) ধর্মীয় মেলা — গঙ্গাসাগরের মেলা, হরিদ্বারে বা প্রয়াগরাজে কুম্ভমেলা, পুরীর জগন্নাথের রথের মেলা, নবদ্বীপে শান্তিপুরের রাসের মেলা, চন্দন নগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর মেলা, তারকেশ্বরের গাজন ইত্যাদি ।
(২) বিভিন্ন মনীষী স্বরণে মেলা — যেমন বাংলার কান্তকবি জয়দেবের স্মরণে কেন্দুলিতে মেলা বসে, এক মাস ধরে । নদীয়ায় ফুলিয়ায় রামায়ণের অনুবাদক কবি কৃত্তিবাসের স্মরণে মেলা বসে । ছাতনায় চন্ডীদাসের মেলা প্রভৃতি । শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা খুবই বিখ্যাত । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন । সেই ঘটনার স্মরণেই ১৩০২ সালের ৭ই পৌষ এই মেলার সূচনা হয় । যা এখনো সমহিমায় চলছে ।
(৩) আধুনিক মেলা — বর্তমান সময়ে মেলারও নানান পরিবর্তন ঘটেছে । আধুনিক জীবন নগর কেন্দ্রিক হওয়ায় শহরে প্রচলিত হয়েছে বাণিজ্য মেলা, শিল্প মেলা, বই মেলা, খাদ্য মেলা, সংস্কৃতি মেলা, পর্যটনশিল্পের মেলা প্রভৃতি । আরো নানান ধরনের মেলা বসছে নিত্যদিন ।
মেলার সাধারণ চিত্র : — মেলা মানেই প্রচুর মানুষের সমাগম । ফলে ভিড়, ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি, হট্টগোল, হরেক রকম বাঁশির আওয়াজ থাকবে । আর থাকবে রঙ বেরঙের পোশাক পরা বহু ভাষাভাষীর মানুষজন । মনভোলানো জিলাপি, জিভেগজা থেকে শুরু করে চপ, বেগুনি, ফুচকা বিরিয়ানির সমারোহ প্রতিটি মেলায় থাকবে । খাবারের ব্যাপারে 'নো কম্প্রোমাইজ' । মেলার আর একটা জনপ্রিয় আকর্ষণ ম্যাজিক শো, সার্কাস শো, যাত্রা, বাউল গানের আসর, বড় ও ছোটদের নাগরদোলা, নানা রকমের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা । এছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র থাকে । সব দিক থেকেই লক্ষ্য করলে দেখা যায় মেলায় মানুষ সব দিক থেকেই উপকৃত হয় এবং উপভোগ করে সমানে ।
মেলার প্রয়োজনীয়তা :— মানব মনের অনাবিল আনন্দের জন্য, মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের জন্য, অজানা বিষয় বা জায়গাকে ভালো ভাবে জানার জন্য, মেলার প্রয়োজন আছে । এ ছাড়া অর্থনৈতিক প্রয়োজনেও মেলার ভূমিকা রয়েছে । মেলায় প্রচুর জিনিস বেচাকেনা হয় । স্থানীয় মানুষজনের তৈরি জিনিস যেমন মেলায় বিক্রি হয় তেমনি বিভিন্ন জায়গা থেকেও উৎপাদিত জিনিস মেলায় বিক্রি হয় । এতে অর্থনৈতিক দিকের ও অনেকটা উন্নতি হয় । এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় কারণেও মানুষ মেলায় উপস্থিত হয় । ধর্মীয় আদান-প্রদান ও হয় এখানে ।
উপসংহার :— মেলা লোকসংস্কৃতির পরিচয়বাহী । মেলায় জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের আগমন ঘটে বলে এখানে মানুষ যেমন আনন্দ উপভোগ করে তেমনি মানুষের মন থেকে সংকীর্ণ জাতিভেদ, ধর্মভেদ দূর হয় । মানুষ একত্রে মিলিত হয় । মেলা হল সৃজনশীলতার একটা ক্ষেত্র । এখান থেকে অনেক শিল্পীর জন্ম হয় । গানের শিল্পী, মৃৎশিল্পী, ভাস্কর্যের শিল্পীর সন্ধান পাওয়া যায় । বহু অখ্যাত গ্রাম খ্যাতির আলো পায় । মেলার হট্টগোলে সাধারণ জীবনযাত্রায় কিছুটা অসুবিধা হয় ঠিকই কিন্তু সেটা বাদ দিলে লাভের পাল্লাই থাকে বেশি । তাই যুগ যুগ ধরে মেলা বসে চলেছে — আর যুগ যুগ ধরেই চলবে ।
***