অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও প্রথমদিকে তারা এদেশে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি । ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজদের আইন-আদালত গড়ে উঠতে শুরু করে । ইংরেজ বণিকরা নানা জায়গায় নিজেদের বাণিজ্যাগার গড়ে তুলতে শুরু করে । এই সমস্ত স্থানে কর্মরত ভারতীয়দের ইংরেজি জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । এই সময় কিছু বিদেশি এবং কয়েকটি খ্রিস্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে এদেশে বিভিন্ন ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে । এছাড়া ভারতের কিছু সচেতন ও প্রগতিশীল ব্যক্তি এদেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ উদ্যোগ নেন ।
এই প্রেক্ষাপটে শোরবার্ন, মার্টিন, বাউল, আরটুন, পিট্রাস, ডেভিড ড্রামণ্ড, ডেভিড হেয়ার প্রমূখ কয়েকজন বিদেশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতায় কয়েকটি ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন । এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ডেভিড ড্রামণ্ডের 'ধর্মতলা অ্যাকাডেমি' এবং ডেভিড হেয়ারের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ।
বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারি গোষ্ঠী খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতে এসে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের চেষ্টা চালায় । তাদের উদ্যোগে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে বেশকিছু ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে ওঠে । (১) লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে চুঁচুড়ায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । (২) স্কটিশ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার ডাফ -এর প্রচেষ্ঠায় বাংলায় বেশকিছু ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত 'জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন' যার বর্তমান নাম স্কটিশচার্চ কলেজ । (৩) ব্যাপ্টিস্ট মিশনের উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, ওয়ার্ড প্রমুখের উদ্যোগে ১২৬টি বিদ্যালয় ও এই মিশনের উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় । (৪) মিশনারিদের উদ্যোগে একে একে শিবপুরের বিশপ কলেজ, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার 'সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ' ও ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে 'লরেটো হাউস স্কুল' গড়ে ওঠে ।
ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় এবং সুপ্রিমকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট -এর উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে 'হিন্দু কলেজ' যার বর্তমান নাম 'প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়' ।
১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে কমিটি অব পাবলিক ইনসট্রাকশন পুনর্গঠিত করে গড়ে তোলা হয় কাউন্সিল অব এডুকেশন । এই সংগঠনটির উদ্যোগে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ১৫১টি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সমস্ত বিদ্যালয়গুলিতে ১৩,০০০ -এরও বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় । ইংরেজি ভাষার মেধাবী ছাত্রদের সরকারি উচ্চ পদগুলিতে নিয়োগ করা হবে এই মর্মে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করলে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের প্রবল আগ্রহ দেখা দেয় ।
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড শিক্ষানীতির ওপর একটি পরিকল্পনা পেশ করেন যা 'উডের ডেসপ্যাচ' নামে পরিচিত । এই শিক্ষা পরিকল্পনার যে সমস্ত সুপারিশগুলি করা হয় সেগুলি হল —(১) সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা, (২) দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, (৩) কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিা, (৪) একটি পৃথক শিক্ষাদপ্তর গঠন করা, (৫) উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবে 'ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন' -এর পদ সৃষ্টি, (৬) শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা, (৭) মাতৃভাষার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার প্রসার, (৮) উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি, (৯) স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি । আধুনিক শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে উডের নির্দেশনামা ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা । এটি ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পাঠক্রম ও অর্থনীতির মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে সক্ষম হয়েছিল । উডের নির্দেশনামা বা ডেসপ্যাচের ওপর ভিত্তি করে ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে । এই জন্য এই নির্দেশনামাকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের 'ম্যাগনাকার্টা' বা 'মহাসনদ' বলা হয় ।
*****